ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিজেকে যথার্থ মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভূমিকা নেওয়ার সময় এসে গেছে। সামনেই ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচন সামনে রেখে সমর্থকদের মধ্যে নিজের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যকে তুলে ধরার একটি সুযোগ তাঁর সামনে এসেছে। আর এই সুযোগটি এসেছে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলাপ-আলোচনার সূত্র ধরে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে ট্রাম্পের মোট তিনবার দেখা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া-সংক্রান্ত সংকট নিরসনে দৃশ্যমান কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ফল আসেনি।
কিম জং-উন কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে সহায়তা করতে একটি পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। গত বছরের জুনে সিঙ্গাপুরে কিমের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকের আগের মাসে (অর্থাৎ ২০১৮ সালের মে মাসে) উত্তর কোরিয়া নিষ্ক্রিয় করা সেই স্থাপনা পরিদর্শন করার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ইয়ংবিওন স্থাপনা নামে উত্তর কোরিয়ার একটি পরমাণু স্থাপনা কেন্দ্র আছে, যেখানে দেশটির ৮০ শতাংশ পরমাণু কার্যক্রম চলে। কিম জং-উন ইয়ংবিওন ধ্বংস না করলেও যেটি ধ্বংস করেছেন সেটিও মার্কিন কূটনীতির একটি বিরাট অর্জন।
গত ফেব্রুয়ারিতে ভিয়েতনামে উনের সঙ্গে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফায় বৈঠক হয়। তবে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর ছাড়াই সেই বৈঠক শেষ হয়। ওই সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, খারাপ চুক্তিতে সই না করা ব্যর্থতা নয় বরং এটি বিজয়ের শামিল। অবশ্য হ্যানয় চুক্তি না হওয়ায় বিশ্ববাসীর কাছে শেষ পর্যন্ত এই বার্তাই গেছে যে ওই সম্মেলনে যোগ দিয়ে ট্রাম্প নিজেই নিজের অবস্থানকে খাটো করেছেন। তবে গত ৩০ জুন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের সঙ্গে সম্মেলনের সময় ট্রাম্প ডিমিলিটারাইজড জোন (ডিএমজেড) দিয়ে উত্তর কোরিয়ার মাটিতে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পা রাখেন।
মুন জে-ইন বলেছেন, ডিএমজেড এলাকায় যতক্ষণ থাকার কথা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় ছিলেন ট্রাম্প। ২৯ জুন ভোরে এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প ডিএমজিতে উনের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। উত্তর কোরিয়া তার চিরাচরিত আচরণের বাইরে গিয়ে ত্বরিত গতিতে ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হয়। এই দুই নেতা বলেছেন, তৃতীয়বারের মতো বৈঠকে বসার বিষয়ে তাঁরা দুজনই প্রাথমিকভাবে একমত হয়েছেন। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি উনকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানাবেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, তৃতীয়বারের মতো দুই নেতার সম্মেলনের সম্ভাব্যতা নিয়ে তাঁরা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠানের আগেই ভালো করে প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করা, এর আগের সম্মেলনে যেটির ঘাটতি ছিল। ট্রাম্প এবং উন যাতে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেন, এমন অবস্থা তৈরি করেই তাঁদের বৈঠকে বসা দরকার।
মুন বলেছিলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার সংলাপে মধ্যস্থতা করতে চান। কিন্তু হ্যানয় সম্মেলনের পর উত্তর কোরিয়া অভিযোগ করেছে, মুনের মধ্যস্থতায় ত্রুটি ছিল বলেই আগের সম্মেলনে কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ কারণে তৃতীয় সম্মেলনে তাঁর কোনো মধ্যস্থতা মানবে না উত্তর কোরিয়া। তবে তাতে মুনের দিক থেকে কোনো আপত্তি বা অসহযোগিতা থাকছে না। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন চাল সহায়তা হিসেবে দিয়েছে। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে এই পদক্ষেপ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ এবং ইরানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে যুক্তরাষ্ট্র বেশ খানিকটা প্রভাব হারিয়েছে। এখন যদি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তৃতীয় সম্মেলনে ভালো কিছু ফল আসে, তাহলে সেই ঘাটতি পূরণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। ট্রাম্পের সর্বশেষ উদ্যোগ ১৯৮৭ সালের ১২ জুন উত্তর বার্লিনে প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের দেওয়া একটি ভাষণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেখানে তিনি সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘বার্লিন দেয়াল ভেঙে দিন’। তাঁর সেই কথা দুই জার্মানির মানুষের হৃদয়কে আলোড়িত করেছিল।
ট্রাম্পের সামনে সেই ধরনের একটি সুযোগ আসছে। আশা করি, তৃতীয় সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলবেন, ‘মিস্টার উন, পরমাণু অস্ত্র পরিত্যাগ করায় আপনাকে ধন্যবাদ!’ এই সাফল্য অর্জন করতে পারলে ইতিহাস তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মিচ শিন আন্তর্জাতিক কূটনীতিবিষয়ক লেখক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশন বিভাগের শিক্ষার্থী