উদ্ভিদ-কথা

ছোটবেলায় স্কুলে চটি গল্পের বইয়ে পড়েছিলাম: ক্লাসে শিক্ষক ছাত্রকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘উদ্ভিদ কাহাকে বলে?’ প্রত্যুত্তরে ছাত্রটি বলল, ‘যাহা মাটি ভেদ করিয়া ঊর্ধ্বপানে ওঠে, উহাকে উদ্ভিদ বলে।’ শিক্ষক উদাহরণ দিতে বললে এবার ছাত্রটি বলে উঠল, ‘কেঁচো, স্যার।’ তৎকালে এ নিয়ে খুব হাসাহাসি করলেও পরিণত বয়সে এসে অবশ্য জানতে পেরেছি, কেঁচো নামের প্রাণীটি হেলাফেলার নয়; কেননা মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈব প্রক্রিয়ায় কেঁচো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেই ‘প্রকৃতির লাঙল’ উপাধি পেয়েছে। আর বিলেতে বিবিসির প্রোগ্রামে দেখেছিলাম, ইংরেজ কৃষক পরিবার জমিতে হাতের তালু দ্বারা ক্রমাগত থাপ্পড় দিতে থাকলে শত শত কেঁচো মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে।
অপর একজন স্কুলশিক্ষক ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন, ‘বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারত না এবং একেকটি উদ্ভিদ হচ্ছে একেকটি অক্সিজেন ফ্যাক্টরি, যেহেতু উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয় ও অক্সিজেন ছাড়ে। আর অক্সিজেন কে আবিষ্কার করেছেন জানো? জোসেফ প্রিস্টলি নামক একজন ইংরেজ পাদরি, ১৭৭৪ সালে।’ ক্লাসের সর্বকনিষ্ঠ ছাত্রটি তখন তাঁকে প্রশ্ন করে বসল, ‘তাহলে তৎপূর্বে মানুষ বাঁচত কেমন করে স্যার?’ বলাবাহুল্য, ইংরেজিতে ‘ইনভেন্ট’ ও ‘ডিসকভার’ শব্দদ্বয়ের বিপরীতে বাংলায় একটিমাত্র ক্রিয়াপদ ‘আবিষ্কার করা’ হওয়াতে ছেলেটির মনে এ রকম প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল।
সে যাই হোক। আমাদের জীবনে উদ্ভিদ তথা বৃক্ষ তথা গাছগাছালির গুরুত্ব যে অপরিসীম, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অক্সিজেন ব্যতিরেকেও উদ্ভিদ থেকে আমরা পাই নানা খাদ্যদ্রব্য, কাঠ, কয়লা, জ্বালানি, কাগজ, এমনি আরও কত-কী! তা ছাড়া নানা রকম ওষুধও পাই উদ্ভিদ থেকে। ম্যালেরিয়ার মহৌষধ কুইনাইন, যেটা আবিষ্কার করেছিলেন ইংরেজ চিকিৎসক রোনাল্ড রস, সেটাও তো ‘সিনকোনা’ নামক উদ্ভিদ থেকে তৈরি। অপরদিকে সভ্যতার সূচনালগ্নে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে যে ‘হেমলক’ বিষপানে হত্যা করা হয়েছিল, সেটাও সেই নামের উদ্ভিদ থেকেই ছিল আহরিত।
ইশপের নীতি গল্পেও উদ্ভিদ যথারীতি বিদ্যমান। ছোটবেলায় গল্প পড়েছিলাম: কাজি তথা বিচারকের কাছে ঋণদাতা বিচারপ্রার্থী—ঋণগ্রহীতা ঋণের কথা অস্বীকার করছেন। কোনো মানব-সাক্ষীর অভাবে যে বৃক্ষের নিচে ঋণদান সম্পন্ন হয়েছিল সেটাকে সাক্ষ্য দিতে আসার জন্য কাজি ঋণদাতা মারফত সমন পাঠালেন ও বিবাদীকে কাছে বসিয়ে রাখলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর ঋণদাতা ফিরে এসে হতাশা ব্যক্ত করতেই কাজি সাহেব বলে উঠলেন, বৃক্ষ এসে তোমার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে গেছে। তুমি যাওয়ার পর একসময়ে হঠাৎ আমি বিবাদী লোকটিকে তুমি বৃক্ষের কাছে পৌঁছে গেছো কি না জিজ্ঞেস করতেই সে জবাব দিল, ‘না হুজুর, এখনো বোধ হয় পৌঁছায়নি।’
আর উদ্ভিদ সম্পর্কে কিছু ‘মিথ’ আছে। প্রথমত, আমরা মানুষখেকো উদ্ভিদের কথা শুনতে পাই; বাস্তবে কিন্তু বিজ্ঞানীরা মানুষখেকো উদ্ভিদ বলে কোনো কিছুর সন্ধান পাননি। তবে পৃথিবীতে রয়েছে মাংসখেকো উদ্ভিদ, যেগুলো তাদের সুগন্ধি ফুল ও কটু গন্ধ দ্বারা ক্ষুদ্র কিছু প্রাণীকে আকৃষ্ট করে এবং একধরনের আঠালো পদার্থ দ্বারা আটকে ফেলে ক্রমেই তা খাদ্যে পরিণত করে। ইদানীং পত্রিকায় বেরিয়েছে, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ ও নিউজিল্যান্ডে পিসেনিয়া নামক উদ্ভিদ ‘পাখিখেকো গাছ’ বলে পরিচিতি লাভ করেছে।
দ্বিতীয়ত, আমরা সাধারণত জানি যে গাছপালা আজীবন একই জায়গায় স্থির হয়ে থাকে; অথচ এমন কিছু গাছপালা আছে, সেগুলো নিজেরাই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাফেরা করতে পারে। এই যেমন, আঠালো আকৃতি ও প্রকৃতির গাছপালার ‘অ্যামিবা’র মতো যাতায়াত শক্তি আছে এবং একরকম সমুদ্র শৈবাল আছে, যেগুলো চাবুকের মতো অঙ্গ দ্বারা পানির মধ্যে সাঁতার কেটে চলে।
তাই বৈজ্ঞানিক আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু যথার্থই বলে গেছেন, উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে এবং জীবজন্তুর ন্যায়ই পৃথিবীর অনেক উদ্ভিদও আত্মরক্ষার উপায় উদ্ভাবন করে থাকে। গিরগিটি যেমন আত্মরক্ষার্থে গায়ের রং পাল্টাতে পারে, তেমনি কিছু উদ্ভিদ আছে বিষাক্ত এবং কোনো জন্তু যদি ওগুলোকে খায় বা স্পর্শ করে তাহলেই বিপদ। এ ক্ষেত্রে ক্যাকটাস ও বিছুটি গাছের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। একসময়ে বিলেতে অবস্থানকালে পায়ে বাড়ির প্রাঙ্গণস্থ বিছুটি লেগে আমার তো অবস্থা কাহিল। শেষমেশ আমার ইংরেজ চাচি শাশুড়ির পরামর্শ মোতাবেক বিছুটি গাছের সঙ্গেই গজানো গুল্মলতার পাতা ডলা দিয়ে সে-যাত্রা রক্ষা পাওয়া গিয়েছিল। প্রকৃতিই প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করে রেখেছে।
পরিতাপের বিষয়, বৃক্ষেরও যে প্রাণ আছে, এটা বোধকরি আমাদের পৌর-পিতারা অবগত নন। তা নইলে তেনারা শহরের রাস্তা পাকা করানোর সময় গাছগুলোর একেবারে গোড়া পর্যন্ত পাকা না করে গাছের বিস্তৃতি ও নিশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য চতুষ্পার্শ্বে একটুখানি ফাঁকা জায়গা রেখে দিতেন। এভাবে গাছের টুঁটি চেপে ধরে শ্বাস রোধ করায় গাছগুলো যে অহর্নিশ আর্তনাদ জানায়, সেটা আমাদের যাদের শোনার মন ও কান আছে, তারা প্রতিনিয়তই শুনতে পাই।
এবার আসল প্রসঙ্গ, যেটা মার্কিন মুল্লুক সফরপূর্বক স্বদেশে ফেরত আসা অবধি আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ওখানকার শহরাঞ্চলের আবাসিক এলাকায় প্রতিটি বাড়ির সামনে-পেছনে সবুজ ঘাসের সমারোহ আর ফুটপাত ছয় ফুটের জায়গায় তিন ফুট চওড়া বানিয়ে অবশিষ্ট তিন ফুটে ঘাস ও নির্দিষ্ট দূরত্বে দূরত্বে গাছ লাগিয়ে পরিবেশটাকে কী মোহনীয় করে তোলা হয়েছে! গাছগুলোর গোড়ায় কাঠবিড়ালিদের খেলা করতে দেখে মনে পড়ে যেত কবি নজরুলের ‘খুকী ও কাঠবেড়ালি’ কবিতাটি—কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও? গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
আর গাছের আগায় ঝিঁঝি পোকার অনবরত গান শুনে স্মরণে আসত কাবুলিওয়ালার গল্পটি—সেই যে কাবুলিওয়ালা কালো জামের গাছে অকালে কালো জাম খুঁজতে গিয়ে ঝিঁঝি পোকাকে দু আঙুলে পাকড়াও করে বলে উঠেছিল, ‘চিঁ কর, চোঁ কর; ছুড়েঙ্গা নেহি/ কালা কালা যো হ্যায়, উও কালা জাম হ্যায়?’
আমাদের রাজধানী শহর ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোতে এখন গাছ প্রায় নেই বললেই চলে। তবে ধানমন্ডির কোনো কোনো বাড়ির সামনে দেয়াল ঘেঁষে দেবদারুগাছের সারি এখনো দেখা যায়। এটা খুব পরিবেশবান্ধব অথচ জায়গাসাশ্রয়ী বিধায় আমাদের সরকার আইন করে এটাকে বাধ্যতামূলক করে দিতে পারত। কল্পনা করুন, ঢাকার প্রতিটি ভবনের সামনে দেবদারুগাছের সারি। এর চেয়ে দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য আর কী হতে পারে?
প্রসঙ্গত, আমাদের এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী জিম্বাবুয়ে সফরে গিয়ে পথিপার্শ্বস্থ একটি গাছ দেখে প্রশংসা করায় ফেরার সময় রবার্ট মুগাবে সেটার কিছু বীজ তাঁকে দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বীজ থেকে চারা করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভেতরে কোথায় লাগাবেন, সেটা যখন স্থির করা যাচ্ছিল না, তখন একজন পুরোনো কর্মচারী এগিয়ে এসে বললেন, ‘স্যার, এই জায়গায় লাগান। প্রতিবছর সবাই এই জায়গায়ই তো লাগায়।’
আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷