নির্বাচন এলে সারা ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতির বন্যা শুরু হয়ে যায়। আগামী এপ্রিল–মে মাসে ভারতের আইনসভার (সংসদ) নিম্নকক্ষ লোকসভার ৫৪৩টি আসনে ভোট হওয়ার কথা। এই ভোটকে কেন্দ্র করে সরকারি–বিরোধী কোনো দলের চোখে ঘুম নেই; ভোট টানার উদ্দেশ্যে তারা নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলশাসিত মমতা সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা উদ্বাস্তুদের জমির স্বত্ব দেবে। একই উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদির দল বিজেপি ৮ জানুয়ারি লোকসভায় নাগরিকত্বের সংশোধনী বিল পাস করেছে। তারা বলেছে, ভারতভাগের পর বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যেসব অমুসলিম নাগরিক ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই তালিকায় রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ। এই বিলটি ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হওয়ার দিনই তৃণমূল সংসদে দাবি তুলেছিল, এই তালিকায় মুসলিম সম্প্রদায়কেও অন্তর্ভুক্ত করা হোক। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে এটা সমীচীন নয়। এই বিল ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া উচিত। কিন্তু বিজেপি তৃণমূলের এই প্রস্তাব আমলে নেয়নি।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি লোকসভার পর রাজ্যসভায় পাস হওয়া প্রয়োজন। তার আগে এটা কার্যকর হবে না। কিন্তু রাজ্যসভায় পাস করানোর মতো গরিষ্ঠতা বিজেপির নেই বলে বিলটি সেখানে পেশ করাই হয়নি। আপাতত সেটা হিমঘরে চলে গেছে।
এবারের লোকসভার নির্বাচনে বিষয়টি নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন রশি টানাটানি। বিজেপি বলছে, তারা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দিতে চায়, কিন্তু এই বিলের বিরোধিতা করছে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস ও বাম দল। এই প্রশ্নও উঠেছে: ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় গেলে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও সে প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি। আবার নির্বাচন আসায় মাঠে নেমে পড়েছেন মোদি। এটা ভোটার আকর্ষণের ধোঁকাবাজির রাজনীতি ছাড়া কিছু নয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু বসে নেই। তিনি জানেন, তাঁর রাজ্যে উদ্বাস্তুদের ভোট একটা বড় ফ্যাক্টর। এই রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৭০-৮০টির ফল নির্ভর করে উদ্বাস্তুদের ভোটের ওপর। তাই তাদের ভোট পেতে মমতা বিজেপিকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য মাঠে নেমেছেন। ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার মালিক কেন্দ্রীয় সরকার। তাই এ ক্ষেত্রে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে। নাগরিকত্ব বিল লোকসভায় পাস হওয়ায় উদ্বাস্তুরা খুশি হয়েছে।
এখন মমতা তাদের খুশি করতে আরও বড় প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন: পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের জমিতে যেসব উদ্বাস্তু বসতি স্থাপন করে আছে, তাদের সেই ভোগদখলীয় জমির স্বত্ব দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারের জমিতে ও কেন্দ্রীয় সরকারের জমিতে বসতি স্থাপন করে বসবাসরত উদ্বাস্তুদের তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের জমিতে বসতি স্থাপনকারী উদ্বাস্তুদের জমির স্বত্ব দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। কিন্তু তিনি এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখেছেন।
এভাবে ভারতে ভোটের রাজনীতি বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে। মোদি বলছেন, উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেব, মমতা বলছেন জমির স্বত্ব দেব।
কিন্তু সত্যিই কি উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব আর জমির স্বত্ব শিগগির পাবে? এটা নিয়ে উদ্বাস্তুদের মধ্যে তর্ক–বিতর্ক, জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। ১৯৪৭–এর ভারত ভাগ, ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আসা উদ্বাস্তুরা এখনো নাগরিকত্ব পায়নি। অনেকেই জমির স্বত্ব পায়নি।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছেন ২০১১ সালে, দ্বিতীয়বার ২০১৬ সালে। কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে ২০১৪ সালে। এত সময় পেয়েও তারা উদ্বাস্তুদের জন্য এসব অধিকার দেয়নি। ফলে তাদের মনে প্রশ্ন: এত দিনেও যখন দেওয়া হয়নি, তখন কি সত্যিই দেওয়া হবে? নাকি এসব প্রতিশ্রুতি শোনানো হচ্ছে শুধু ভোটের জন্য?
বলা ভালো, ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের আন্দোলন যখন জোরালো হচ্ছিল, তখন ছিটমহল বিনিময়ের জন্য সংবিধান সংশোধনে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট বা ইউপিএ সরকার বারবার চেষ্টা করেছে ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করাতে। কিন্তু পারেনি কংগ্রেস সরকার। সেদিন বাধা দিয়েছিলেন তৃণমূল এবং বিজেপির সাংসদেরা। ফলে ইউপিএ সরকার আর সেই বিল পাস করাতে পারেনি। পারেনি মনমোহন সিং সরকার। তবে মোদি ক্ষমতায় আসার পর সেই বিল পাস করে বিজেপি। সমর্থন দেয় তৃণমূল কংগ্রেস।
তাই বলতে হয়, রাজনীতিতে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এসব প্রতিশ্রুতি দেওয়ার খেলা চলে। উদ্বাস্তুরাও এখন সেই খেলার বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই বল খেলছে দুই দল—বিজেপি ও তৃণমূল। ভোট বাগাতে কোন দল আগে উদ্বাস্তুদের ময়দানে গোল দেবে তার দিকে তাকিয়ে আছে উদ্বাস্তুরা। তারাও বুঝেছে, এটা রাজনৈতিক খেলা। তবু তারা চাইছে, এই খেলার মধ্য দিয়ে হলেও তারা পেয়ে যাক নাগরিকত্বের অধিকার এবং ভোগদখলীয় জমির স্বত্ব।
অমর সাহা প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি