গত বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি ভারতের পূর্ব লাদাখের ভারত-চীন নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর গালওয়ান ভ্যালিতে চীন ও ভারতের সেনাদের মধ্যে নিরস্ত্র সংঘর্ষ ঘটেছিল। ওই সংঘর্ষে ভারতের অন্তত ২০ জন সৈনিক মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনার পর পুরো লাদাখ সীমান্ত ও উত্তর-পূর্বের অরুণাচল পর্যন্ত ভারী অস্ত্রসহ দুই পক্ষই সৈন্য মোতায়েন করেছে। এ নিয়ে যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনীতিতে দৃশ্যমান পরিবর্তনের সূচনা করছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনীতির এই নতুন সমীকরণের আঁচ চীনের তিব্বতসংলগ্ন নেপাল, ভুটান এমনকি বাংলাদেশেও লেগেছে। বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত আর চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে, কিন্তু নেপালের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। নেপাল ক্রমেই চীনের ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে এবং নেপালকে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় কার্যত চীন ও ভারতের রশি টানাটানি শুরু হয়েছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে নেপাল-চীন সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে রয়েছে। নেপাল চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সঙ্গে যেমন যুক্ত, তেমনি আলাদাভাবে ট্রান্স-হিমালয়ান বহুমুখী যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সঙ্গেও সংযুক্ত হয়েছে। এতে চীনের সঙ্গে নেপালের যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে। এর মধ্যেই নেপাল নতুন মানচিত্র প্রকাশ করায় তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়। নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিবর্তনের প্রাক্কালেও চীন-ভারতের দৌড়ঝাঁপ লক্ষণীয় ছিল। এককথায় চীন-ভারতের ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন ও সামরিক তৎপরতা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে এক নাজুক অবস্থায় রেখেছে।
কয়েক বছর ধরেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময় এ উদ্যোগ গতি পায়। এর মধ্য দিয়েই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হিসেবে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং ভূকৌশলগত প্রতিযোগিতার ঘূর্ণিপাকে প্রবেশ করে। ইন্দো-প্যাসিফিক জোট এই অঞ্চলে একটি চীনবিরোধী সামরিক জোট। এই জোটে ভারতের যোগদানের পর থেকে চীন-ভারতের সম্পর্কের দ্রুতগতিতে অবনতি হতে থাকে। যার কিছু বহিঃপ্রকাশ ঘটে পূর্ব লাদাখ সীমান্ত সংঘর্ষ ও পরবর্তী সময়ে দুই দেশের সীমান্তে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে।
উপমহাদেশের নতুন এই উত্তেজনাকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময়ে সৃষ্ট উত্তেজনার চেয়েও গভীর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। উপমহাদেশের এই উত্তেজনার পেছনে কাজ করছে এ অঞ্চলকে ঘিরে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থান। ট্রাম্প প্রশাসনের চীনবিরোধী আগ্রাসী নীতির প্রেক্ষাপটেই উপমহাদেশে এই নতুন ভূরাজনৈতিক সমীকরণ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয় এবং ডেমোক্র্যাটদের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটে ধারণা করা হয়েছিল যে বাইডেন প্রশাসনের সময়ে হয়তো চীন নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন হবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা প্রশমন হতে পারে। কিন্তু সে ‘আশার গুড়ে বালি’ মনে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয় এবং ডেমোক্র্যাটদের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটে ধারণা করা হয়েছিল যে বাইডেন প্রশাসনের সময়ে হয়তো চীন নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন হবে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা প্রশমন হতে পারে। কিন্তু সে ‘আশার গুড়ে বালি’ মনে হচ্ছে। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে অনুমোদনের পর ‘তিব্বত পলিসি অ্যান্ড সাপোর্ট অ্যাক্ট ২০২০-এ (টিপিএসএ) স্বাক্ষর করে বিল পাস করেছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে রাখা হয়েছে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
টিপিএসএ-২০২০-এর মূল বিষয় হলো ভারতের ধর্মশালায় অবস্থিত স্বাধীন তিব্বত সরকারপ্রধান ও ধর্মীয় প্রধান ১৪তম দালাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচন ও তিব্বতের রাজধানী লামাতে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট স্থাপন। চীন এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে সেখানে কনস্যুলেট খোলার অনুমতি দেয়নি। অপর দিকে চীন নিজের মতো করে তিব্বতে ইতিমধ্যে ১১তম লামা নির্বাচন করেছে। ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক লাখ তিব্বতির কাছে যা গ্রহণযোগ্য হয়নি। এই তিব্বতিরা ১৯৫৯ সালে তিব্বতে চীনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের পর ১৪তম দালাই লামার সঙ্গে ভারতে অবস্থান করছেন। স্মরণযোগ্য যে ১৯৫৯ সালে তিব্বতের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর দালাই লামার ভারতে আশ্রয়ের প্রেক্ষাপটেই ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে ভারত পরাজিত হয় এবং আকসাই চীন চীনের দখলে চলে যায়। সেই যুদ্ধের পর থেকে চীন তিব্বতের সঙ্গে ভারতের যে বর্তমান সীমান্ত তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না।
যুক্তরাষ্ট্রের হালের বিলটিতে বলা হয়েছে যে তিব্বতের ধর্মীয় অঙ্গনে চীনের হস্তক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র মানবে না এবং কনস্যুলেট স্থাপন করতে না দিলে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন শহরে কনস্যুলেট স্থাপনের অনুমোদন দেবে না। অপর দিকে চীনের, বিশেষ করে তিব্বতে চীনের শীর্ষ নেতাদেরসহ অন্যদের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে।
চীন-ভারত উত্তেজনার মধ্যে এই বিলের ওপর ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এ অঞ্চলে নতুন করে তৎপর হতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত তিব্বতের অভ্যন্তরে সিআইএ এবং ভারতের আইবির অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড এবং অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার দৃষ্টান্ত বিবেচনায় নিয়ে অনেকে ভবিষ্যতে একই ধরনের সমস্যার আশঙ্কা করছেন। ১৯৫০ সালে তিব্বতকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে যুক্ত করার পর থেকে তিব্বতের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট তৈরি করে যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ১৯৫০ সালেই প্রথমে যোগাযোগ স্থাপন করে বর্তমান দালাই লামার অগ্রজ গিয়ালো থনডাপের সঙ্গে। ওই সময়ে ভারতের কালিমপং শহরে সিআইএর গোপন অপারেশন আস্তানা স্থাপিত হয় এবং সেখান থেকেই তিব্বতে গোপন অভিযান চলে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতের আইবি। ওই সময় থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার উত্তরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত রানওয়ে (যা বর্তমানে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর) সিআইএ ব্যবহার করে। এখান থেকে তিব্বতের কথিত বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো যুক্তরাষ্ট্রের দখলে থাকা বিভিন্ন দ্বীপে। এদেরকে পরে নেপাল-তিব্বতসংলগ্ন মাসটাং নামে গোপন আস্তানা থেকে তিব্বতের অভ্যন্তরে পাঠানো হতো।
যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতে গোপন কোনো তৎপরতা শুরু করলে তাতে ভারত সহযোগিতা করবে বলে অনেকেই ধারণা করেন। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এ অঞ্চলের দুই দেশ নেপাল ও ভুটানকে কতখানি দলে টানতে পারবে, তা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
লক্ষণীয় হলো ওই সময়ে তিব্বতে সিআইএ-আইবি পরিচালিত গোপন অভিযান সেন্ট সার্কাস এবং সেন্ট বারনাম নামক অভিযানে উপমহাদেশের তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেছে—ভারত-নেপাল ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৫৯ সালে তিব্বতে চীনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা হয়, কিন্তু তারা চীনের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। চীন সর্বশক্তি দিয়ে এ অভ্যুত্থান দমন করে। প্রায় ৪০ হাজার তিব্বতি দালাই লামার নেতৃত্বে ভারতের ধর্মশালায় সরকার গঠন করে তিব্বতের স্বাধীনতার দাবি তোলে। এ প্রেক্ষাপটেই ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে ভারত পরাজিত হয়। যুদ্ধের পর ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণে সিআইএকে এ অঞ্চল ত্যাগ করতে হয়। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির চেষ্টায় পাকিস্তান কুর্মিটোলায় সিআইএর কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতে গোপন কোনো তৎপরতা শুরু করলে তাতে ভারত সহযোগিতা করবে বলে অনেকেই ধারণা করেন। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এ অঞ্চলের দুই দেশ নেপাল ও ভুটানকে কতখানি দলে টানতে পারবে, তা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
করোনা মহামারি-পরবর্তী বিশ্বে চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে বহু এগিয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিয়ে এগোনো কতটা সমীচীন হবে, তা নিয়ে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। করোনা-পরবর্তী ভারতের অর্থনীতির সামনে দিনগুলোতে বেহাল থাকবে বলে মনে করেন ওই দেশের বিজ্ঞজনেরা। কাজেই ভারতের পক্ষে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতেরই ক্ষতি হবে।
যাহোক, দৃশ্যপটে মনে হয় চীন-ভারত উত্তেজনায় তিব্বত নতুন মাত্রা হতে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ বাংলাদেশ যাতে এই ঘূর্ণির বাইরে থাকতে পারে, সেদিকেই আমাদের ভূরাজনীতির বিশেষজ্ঞদের নজর রাখতে হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
hhintlbd@yahoo.com