কলকাতার চিঠি

উঠছেন তামাং, নামছেন গুরুং

পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি জেলা দার্জিলিং এখনো অশান্তির আবর্তে। পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ড গড়ার দাবিতে আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলন গড়ে তোলে পাহাড়ের আঞ্চলিক দল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। তারাই পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার দাবিতে গত ১২ জুন থেকে এই আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলন ঘিরে এখন জনমুক্তি মোর্চা দুটি পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক পক্ষ প্রত্যাহার করতে চাইছে বন্‌ধ্‌। অন্য পক্ষ চাইছে অনির্দিষ্টকালের বন্‌ধ্ চালিয়ে যেতে। ফলে পাহাড়ের জনমুক্তি মোর্চার বিবদমান দুই শিবির এখন মুখোমুখি অবস্থানে। এক শিবিরের নেতৃত্বে আছেন জনমুক্তি মোর্চার বহিষ্কৃত নেতা বিনয় তামাং। আর শিবিরের রাশ এখনো রয়েছে দলের সভাপতি বিমল গুরুং ও সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরির হাতে।

এর ফলেই কার্যত আবার বিভক্ত হয়ে পড়েছে জনমুক্তি মোর্চা। জিএনএলএফের ক্ষেত্রেও এ রকম ঘটেছিল। জিএনএলএফ নেতা সুভাষ ঘিসিং সেদিন পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার জন্য অশান্ত করে তুলেছিলেন পাহাড়। সেই জিএনএলএফের সদস্য ছিলেন বিমল গুরুং। পরে তিনি জিএনএলএফ থেকে বেরিয়ে গড়েন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। সেই বিমল গুরুং হন জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি। জিএনএলএফের মতো জনমুক্তি মোর্চা পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে অশান্ত করে তোলেন পাহাড়কে। কিন্তু এই দুই নেতার আন্দোলনে প্রতিষ্ঠা পায়নি পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ড, বরং এই দুই নেতাই সরকারের সঙ্গে আপস করে দার্জিলিংকে পৃথক একটি স্বায়ত্তশাসিত এলাকার রূপ দিতে পেরেছিলেন।

২০১৪ সালের ২ জুন ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য ভেঙে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গড়া হলে সংবিৎ ফিরে পান জনমুক্তি মোর্চা নেতা বিমল গুরুং। এরপরেই তাঁরা নতুন করে ১২ জুন থেকে শুরু করেন পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার আন্দোলন। ওই সময় আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সেই দাবিকে আমলে নেয়নি। পাহাড়ের আঞ্চলিক দল বাদে পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোনো জাতীয় বা আঞ্চলিক দলই চাইছে না পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র পাহাড়ি জেলা দার্জিলিং এবং এর সন্নিহিত এলাকা নিয়ে নতুন গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠন করতে।

গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার আন্দোলন মূলত শুরু হয় আশির দশকে। তখন দার্জিলিংয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালি ভাষাভাষীরা পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি তোলে। আর এই দাবি আদায়ের জন্য হাল ধরে সেদিনের জিএনএলএফ বা গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফোর্স। ১৯৮০ সালে সুভাষ ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এই জিএনএলএফ। তারাই মূলত পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি তুলে অশান্ত করে তোলে দার্জিলিং। আন্দোলনের মাত্রা এতই তীব্র হয় যে দার্জিলিং পর্যবসিত হয় একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপরূপে। জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে জেরবার হয় দার্জিলিং। সেই আন্দোলনে দার্জিলিংয়ে ১ হাজার ২০০ মানুষের প্রাণ যায়। জিএনএলএফ দাবি তোলে দার্জিলিং, ডুয়ার্স আর তরাই অঞ্চল নিয়ে গড়তে হবে পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ড। গোর্খাদের নিজস্ব আবাসভূমি।

পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারও ব্যর্থ হয় এই আন্দোলন রুখতে। এরপর এগিয়ে আসে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক কাঠামোর মধ্যে থেকে পৃথক একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গঠিত হয় দার্জিলিংয়ে। ১৯৮৮ সালের ২২ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং জিএনএলএফ মিলে গড়ে তোলে ‘দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল’ বা পার্বত্য পরিষদ। এর চেয়ারম্যান হন সুভাষ ঘিসিং। এই পার্বত্য পরিষদের নির্বাচনের মাধ্যমে একটানা ২০ বছর সুভাষ ঘিসিং চেয়ারম্যান পদে থাকেন। কিন্তু ২০০৪ সালে গোর্খা পার্বত্য পরিষদের নির্বাচন না হলে জিএনএলএফের মধ্যে শুরু হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। আর এই দ্বন্দ্বের জেরে গোর্খা পার্বত্য পরিষদের সদস্য ও কাউন্সিলর বিমল গুরুং জিএনএলএফ ছেড়ে গঠন করেন নতুন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। সেই ২০০৭ সালের ৭ অক্টোবর। দার্জিলিংয়ের মানুষ এসে দাঁড়ায় বিমল গুরুংয়ের পাশে। শুরু করে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে আবার আন্দোলন।

এই আন্দোলন বেগবান হয় যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে দাঁড়ান বিমল গুরুংয়ের পাশে। সাহস দেন তাঁর দল ক্ষমতায় এলে তিনি পাহাড় সমস্যার সমাধান করবেন। অবশেষে ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন মমতা। হন মুখ্যমন্ত্রী। এরপরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যস্থতায় কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে দার্জিলিংয়ে গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিটিএ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গড়ে তোলা হয়।

এবার দার্জিলিংয়ে শান্তি ফেরাতে মমতা সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন ২৯ আগস্ট। সেই বৈঠকে যোগ দেন বিমল গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমন্বয়ক বিনয় তামাং। তিনি এই বৈঠকের পর দার্জিলিংয়ে ১২ জুন থেকে চলা অনির্দিষ্টকালের বন্‌ধ্ প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন। বলেন, ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে এই বন্‌ধ্। ওই দিনই আবার মমতা উত্তরবঙ্গের উত্তরকন্যা সচিবালয়ে পরবর্তী সর্বদলীয় বৈঠকে বসবেন। এদিকে বিনয় তামাংয়ের বিরুদ্ধে বিমল গুরুং অভিযোগ তোলেন, বিনয় তামাং দলের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে মমতার সঙ্গে ‘গোপন সমঝোতা’ করেছেন। ফলে বিভক্ত হয়ে পড়ে জনমুক্তি মোর্চা। বিমল গুরুং দলের সমন্বয়কের পদ থেকে সরিয়ে দেন বিনয় তামাংকে। আর এতে করে জনমুক্তি মোর্চা কার্যত দুভাগে পরিণত হয়ে যায়।

বিমল গুরুং একদিন জিএনএলএফ থেকে পদত্যাগ করে গড়েছিলেন নতুন দল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। আবার বিমল গুরুংয়ের দলে থেকে তাদেরই নেতা বিনয় তামাং কি আরেকটি দল গড়তে চলেছেন? এই প্রশ্নই এখন রাজনৈতিক মহলে। কারণ, বিনয় তামাংকে এখন মদদ দিচ্ছে তৃণমূল। যেমনটা একদিন বিমল গুরুংকেও মদদ দিয়েছিল তৃণমূল। তাই প্রশ্ন এসেছে, জিএনএলএফের মতো ভেঙে যাবে কি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা? কারণ, এখন দেখা যাচ্ছে, বিনয় তামাং রাজনীতিতে উঠছেন আর বিমল গুরুং নামছেন। একদিকে বিমল গুরুং, অন্যদিকে বিনয় তামাং। দার্জিলিংয়ের এক অংশের মানুষ যে আর বন্‌ধ্ চাইছে না, তা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষও কখনো চায় না যে দার্জিলিং এই রাজ্যের মানচিত্র থেকে বেরিয়ে যাক, সৃষ্টি হোক নতুন রাজ্য গোর্খাল্যান্ড।

অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।