ঈদের আনন্দ হোক সর্বজনীন ও নিরাপদ

ইসলামে দুটি ঈদ বা উৎসব। ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ এবং ঈদুল আজহা তথা কোরবানির ঈদ। ঈদ মানে আনন্দ; কোরবানি হলো ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন। কোরবানি ঈদ হলো ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সফলতার খুশি। এটি মূলত ইবাদতের আনন্দ ও আত্মত্যাগের উৎসব। এই কোরবানি মানব ইতিহাসের সূচনা থেকে বিদ্যমান। ঈদ হলো দায়িত্ব পালন ও কর্তব্যকর্ম সম্পাদনের আনন্দ, পাপমুক্তির আনন্দ, সফলতার আনন্দ। মনের সব কালিমা দূর করে, মান-অভিমান বিসর্জন দেওয়ার আনন্দ। পশুবৃত্তি, পাশবিকতা তথা মনের পশুকে কোরবানি বা পরাজিত করার আনন্দ।

কোরবানি প্রভুপ্রেমের পরীক্ষা। কালক্রমে বিভিন্ন রূপে কোরবানি চলে আসছে। সামর্থ্যবান নারী ও পুরুষদের জন্য কোরবানি একটি ওয়াজিব আমল, যা কার্যত ফরজের মতোই বাধ্যতামূলক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সকল সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান দিয়েছি, তিনি (আল্লাহ) তাদের জীবনোপকরণসহ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে (কোরবানি করে)।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৩৪)। ‘আমি তোমাকে প্রাচুর্য দান করেছি। তুমি তোমার রবের জন্য সালাত আদায় করো এবং কোরবানি (পশু জবাই) করো।’ (সুরা-১০৮ কাউসার, আয়াত: ১-২)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘যার পশু জবাই দেওয়ার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২১২৩, মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড: ১৬, পৃষ্ঠা: ১২০, হাদিস: ৮২৭৩, জামে সহিহ্ আলবানি)। হিজড়ারা সামর্থ্যবান হলে তাদের ওপরও নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো কোরবানি ওয়াজিব হবে।

কোরবানির গোশতসহ সব দান–অনুদান প্রদানের বিশেষ তিনটি খাত রয়েছে। প্রথমত, নিজ পরিবারের সদস্য, দ্বিতীয়ত, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া–প্রতিবেশী, তৃতীয়ত, গরিব-মিসকিন–অসহায়–অভাবী মানুষ। কোরবানির গোশত শুধু তিন ভাগ নয়, বরং ওই তিন খাতে চাহিদা ও প্রয়োজনমতো বেশি–কমও দেওয়া যাবে। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘এবং তিনি (আল্লাহ) তাদের চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার ওপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে (১০, ১১ ও ১২ জিলহজ) তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে (কোরবানি করতে) পারে। অতঃপর তোমরা তা হতে আহার করো এবং দুস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ২৭-২৯)।

জিলহজ মাসের ৯ তারিখ আরাফার দিনের ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর পর তাকবির বলা ওয়াজিব। এই তাকবিরকে তাকবিরে তাশরিক বলা হয়। ভুলে গেলে যখনই স্মরণ হবে, তখনই পড়ে নিতে হবে। ঈদের নামাজে যাওয়া–আসার পথে এই তাকবির বলা সুন্নাত। তাকবিরটি এভাবে বলা সুন্নাত ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। অর্থাৎ আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা। (সুনানে তিরমিজি)।

ঈদের রাত ইবাদতের বিশেষ রাতগুলোর অন্যতম; ঈদের সুন্নাতগুলো হলো ঈদের রাতে বেশি বেশি নফল ইবাদত–বন্দেগি করা। ঈদের রাতে ঘুমানোর আগে চোখে সুরমা ব্যবহার করা। ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, ফজরের নামাজ পুরুষেরা মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করা ও নারীরা নিজ গৃহে আওয়াল ওয়াক্তে আদায় করা, প্রভাতে মিছওয়াক করা ও গোসল করা। ভোর হতে পানাহার থেকে বিরত থাকা এবং সম্ভব হলে কোরবানির গোশত দ্বারা প্রথম আহার করা অথবা কোরবানি পশু জবাইয়ের পর প্রাতরাশ গ্রহণ করা।

সম্ভব হলে নতুন পোশাক বা সাধ্যমতো ও সামর্থ্য অনুযায়ী সুন্দর এবং উত্তম ইসলামি সুন্নতি লেবাস, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরিধান করা। টুপি ও পাগড়ি পরিধান করা। আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা। পুরুষেরা ও ছেলেরা ঈদের মাঠে যাওয়া ও ঈদের জামাতে শামিল হওয়া এবং খুতবা শোনা। সম্ভব হলে ঈদগাহে এক পথে যাওয়া ও অন্য পথে ফিরে আসা। ঈদের মাঠে যাওয়া–আসার পথে সশব্দে জোরে জোরে তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলা। সম্ভব হলে ঈদগাহে বা খোলা মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করা। স্থানীয় কবর ও আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করা। একে অন্যকে আপ্যায়ন করানো ইত্যাদি।

ঈদের আনন্দ উদ্‌যাপনে ও কোরবানি সম্পাদনে সব ধরনের শরিয়তের মাসআলা–মাসায়েলের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলতে হবে। যাতে সাময়িক আনন্দ দীর্ঘ মেয়াদে বেদনার কারণ না হয়। কোলাকুলি ঈদের দিনের জন্য নির্দিষ্ট নয়। সাধারণত স্বাভাবিক অবস্থায় আপনজন বা প্রিয়জনের সঙ্গে দীর্ঘ বিরতির পর সাক্ষাৎ হলে এটি প্রযোজ্য; তবে বর্তমান কোভিড-১৯ করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে এটি থেকে নিবৃত্ত থাকাই শ্রেয়। মনে রাখতে হবে, যদিও যুক্তি ও বিজ্ঞান দ্বারা ইসলামের বিধান নিয়ন্ত্রিত নয়, তবে ইসলামি বিধানগুলো যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত।

ঈদগাহে বা ঈদের জামাতে যাওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং ফিরে এসে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধৌত করতে হবে। প্রতিটি মসজিদে, ঈদগাহে, মার্কেটে বা বাজারে ও দোকানে প্রবেশপথে এবং বাড়ির বা ঘরের সামনে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা বাঞ্ছনীয়।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

smusmangonee@gmail.com