মতামত

ইয়াঙ্গুনের গেরিলারা কি টিকে থাকতে পারে?

মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলীয় কারেন রাজ্যের শসস্ত্র গ্রুপ কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন ব্রিগেডের গেরিলারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।গত ৯ মে ছবিটি তোলা।
ছবি: এএফপি

প্রতিবছরের ২৭ মার্চ মিয়ানমারে ‘আর্মড ফোর্সেস ডে’ পালিত হয়। উৎসবের মতো থাকে এই উদ্‌যাপন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জেনারেল অং সানের নেতৃত্বে জাপানিদের প্রতিরোধপর্ব থেকে এই উদ্‌যাপনের রেওয়াজ। বামারদের খুব ভরসার জায়গা ছিল ‘তাতমাদৌ’ নামে পরিচিত তাদের সশস্ত্র বাহিনী। সেই বামাররা তাতমাদৌর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে এখন। কয়েক মাস আগেও যা অকল্পনীয় ছিল। নিশ্চিতভাবে আগামী বছরের ২৭ মার্চের উদ্‌যাপনে থাকবে বিপুল ভিন্নতা। রেঙ্গুন, মান্দালে কিংবা বাগোর মতো মধ্য মিয়ানমারের শহরগুলোর বাড়িঘরে মানুষ এখন রীতিমতো কান খাড়া রাখে গোলাগুলির শব্দ শুনতে। তাদের নতুন ভালোবাসা গণতন্ত্রপন্থী কিশোর-তরুণদের পিপলস ডিফেন্স ফোর্স বা ‘পিডিএফ’। ধীরে ধীরে গ্রাম-শহর সর্বত্র সর্বাত্মক এক গেরিলা যুদ্ধ ছড়াচ্ছে দেশটিতে। পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা মেলে ১৯৭১-এর মার্চ–পরবর্তী বাংলাদেশের।

তাতমাদৌর সামরিক ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে
মিয়ানমারে গেরিলা যুদ্ধ নতুন কিছু নয়। কিন্তু ইয়াঙ্গুন ও মান্দালের মতো প্রধান শহরগুলোতে নিকট অতীতে সশস্ত্রতার আঁচ লেগেছে কম। এত দিন ‘গেরিলা জোন’ ছিল শান, কাচিন ও কারেনদের দূর পাহাড়গুলো। এখন রাতারাতি শহরগুলো ঢুকে পড়ছে গেরিলা যুদ্ধের আবহে। ২২ ও ২৩ জুন দুই ঘটনায় মান্দালে ও সাগাইনে তাতমাদৌর প্রায় ২০ জওয়ান নিহত হলো। সঙ্গে অং মাইয়ো খ্ নামের একজন লে. কর্নেলও। ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর এটাই কোনো এক অভিযানে তাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। মান্দালের শহরাঞ্চলে বহুকাল পর এমন ঘটল। তাতমাদৌর একদল সৈনিক পিডিএফের একটা গোপন আস্তানায় হানা দেওয়ার পর বোঝা গেল, লক্ষ্যস্থলের কিশোর দল আগেই অভিযানের খবর জানত। জওয়ানরা সহজে সেই অ্যামবুশে পড়ে যায়। পিডিএফের কিছু কিশোর গেরিলাও তাতে মারা পড়ে। ছয়জন গ্রেপ্তারও হয়।

মিয়ানমারজুড়ে পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, আন্তর্জাতিক কূটনীতির পরিসরেও সামরিক জান্তার জন্য এখনো বড় কোনো অস্বস্তি তৈরি হয়নি। চীনের পাশাপাশি রাশিয়াও তাদের ভালোভাবে মদদ দিচ্ছে। জাপান ও ভারতের মতো বড় শক্তিরাও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো শুরু করেনি।

ঘটনাটি আন্তর্জাতিক তাৎপর্য নিয়েও হাজির হয়েছে। ঠিক ওই সময় তাতমাদৌর প্রধান জেনারেল মিং অং হ্লাইন মস্কো সফরকালে ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’ দেখাতে তৎপর ছিলেন।

এ রকম বড় হামলার বাইরে প্রতি রাতে বিভিন্ন স্থানে স্বল্প মাত্রায় গোলাগুলি হচ্ছে পিডিএফের তরফ থেকে। তাতমাদৌ নিজেও বিভিন্ন এলাকায় ঘেরাও করে তল্লাশি চালায়। তল্লাশির লক্ষণ দেখলেই মানুষ রাতের মতো পালাচ্ছে শহর ছেড়ে প্রান্তের দিকে। সরকারি বাহিনী তখন নির্বিচারে জ্বালিয়ে দিচ্ছে ঘরবাড়ি, খামার। কোনো সশস্ত্র বাহিনী যখন নিজ নাগরিকদের বিরুদ্ধে এভাবে যুদ্ধে নামে, তখন তার চেয়ে আত্মবিনাশী আর কিছু হতে পারে না।

গেরিলা সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছে রেঙ্গুন
রাখাইন ব্যতীত মিয়ানমারের প্রায় সর্বত্র কমবেশি একই অবস্থা এখন। প্রান্তিক প্রদেশগুলোর মধ্যে চিন, কাচিন ও কারেন এলাকায় বেশ বড় পরিসরে পাল্টাপাল্টি আক্রমণ হচ্ছে। চিন প্রদেশে ১০ জুন একজন আর্মি ক্যাপ্টেনসহ তাতমাদৌর ২৭ জন সৈনিক মারা গেল চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্সের সঙ্গে সংঘর্ষে। এসব যতটা পুরোনো আঞ্চলিক যুদ্ধের জের, তার চেয়েও বেশি সামরিক আদলে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার নতুন পণ। যেমন চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স পুরোদস্তুর একটা আনকোরা সংগঠন। বহু অঞ্চলে নিজ নিজ নামে এ রকম সশস্ত্রতার সূত্রপাত দেখা যাচ্ছে।

বিশেষ করে রেঙ্গুনে ১৮ জুন যেভাবে ঠান্ডা মাথায় সৈনিকবোঝাই একটা সামরিক যান উড়িয়ে দেওয়া হলো, তাতে বোঝা যাচ্ছে, দেশের প্রধান এই শহর গেরিলা অভিযানের নতুন নতুন খবর দিতে থাকবে সামনে। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সামরিক বাহিনীর সমর্থক ইউএসডিপি দলের দপ্তরের সামনে এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যা বেশ কয়েক দিন রেঙ্গুনে টক অব দ্য টাউন ছিল। এ ঘটনার আগে-পরে জান্তার সমর্থক কর্মকর্তারা রেঙ্গুনের বিভিন্ন স্থানে হামলার শিকার হচ্ছেন নিয়মিত।

অস্ত্র বেচার প্রতিযোগিতায় নেমেছে চীন-রাশিয়া
যদিও মিয়ানমারের শহরগুলো এখন আর জান্তার প্রত্যাশামতো স্বাভাবিক নেই, কিন্তু সামরিক ভারসাম্য নিশ্চিতভাবে তাদের দিকে হেলে আছে। এর কারণ পিডিএফের হাতে উন্নত হাতিয়ার না থাকা। পুরোনো দেশি বন্দুক সংগ্রহ এবং স্মৃতি থেকে ধার করা ফর্মুলায় বোমা তৈরির যদিও ধুম পড়েছে, কিন্তু সেটা তাতমাদৌর চীনা অস্ত্রের সামনে কমই কাজে দেয়। নতুন শতাব্দীর জুলুমকে পুরোনো শতাব্দীর অস্ত্রজ্ঞানে পরাস্ত করতে যাওয়ার ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চিতভাবে বেশি। এ ছাড়া বিভিন্ন বিভাগ ও প্রদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকা স্থানীয় প্রতিরোধগুলোর একক কোনো নেতৃত্ব নেই এখনো। এই যুদ্ধের সামরিক ভরকেন্দ্র এখনো শরীরীভাবে অস্পষ্ট। এ রকম অবস্থা গেরিলা যুদ্ধের ছকের মধ্যেই পড়ে অবশ্য। গেরিলা যুদ্ধকে নিয়মিত বাহিনীর মতো নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তার সাবলীল বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়; বরং এ রকম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে যে পাল্টা নিয়মিত বাহিনী গড়ে উঠতে থাকে, সেটা অনেক বেশি কার্যকর হয়।

গেরিলা যুদ্ধের মৌলিক শর্ত জনসমর্থন। সেটা এই মুহূর্তে বামার তরুণদের পক্ষে আছে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, তাতমাদৌকে এখন পুরো মিয়ানমারে অত্যাচার, নিপীড়ন ও নজরদারি করেই কেবল টিকে থাকতে হবে।

তবে মিয়ানমারজুড়ে পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, আন্তর্জাতিক কূটনীতির পরিসরেও সামরিক জান্তার জন্য এখনো বড় কোনো অস্বস্তি তৈরি হয়নি। চীনের পাশাপাশি রাশিয়াও তাদের ভালোভাবে মদদ দিচ্ছে। জাপান ও ভারতের মতো বড় শক্তিরাও বিরুদ্ধে দাঁড়ানো শুরু করেনি। তবে ২০ জুন জেনারেল মিংকে মস্কো বিমানবন্দরে দেশটির উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেকজেন্ডার ফোমিনের স্বাগত জানানো বেশ অস্বস্তিকর দৃশ্য ছিল। এই অস্বস্তি মিং অংয়ের জন্য অবশ্যই বিব্রতকর হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় রাশিয়ার সরকারি বার্তা সংস্থায় জেনারেলকে মিয়ানমারের ‘হেড অব স্টেট’-এর বদলে কেবল ‘মিলিটারি চিফ’ বলা হচ্ছে। অথচ বর্তমানে তাঁর প্রধান রাজনৈতিক পরিচয় তিনি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল (এসএসি)-এর সভাপতি।

তবে যতই অস্বস্তি থাক, রাশিয়াকে জেনারেল মিং–এর দরকার আছে। চীনের পাশাপাশি রাশিয়া তাতমাদৌর অস্ত্রপাতির দ্বিতীয় প্রধান উৎস এবং জেনারেল মিং সেখানে গেছেন মূলত অস্ত্র সংগ্রহে। দেশটিতে গেরিলা যুদ্ধ যত ছড়াচ্ছে, চীন-রাশিয়ার অস্ত্র বেচার সুযোগ বাড়ছে ততই। কিন্তু অস্ত্র চলতি রাজনৈতিক সংকটের কতটা সমাধান দিতে পারে, সেটা বড় প্রশ্নবোধক হয়েই থাকছে।

মিয়ানমারে গেরিলা যুদ্ধের শক্তির জায়গা যেখানে
২০১৭ থেকে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রধান এক খোরাক। রোহিঙ্গাদের পর এখন দেশটি নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, তাতমাদৌর মতো চার লাখ সদস্যের শক্তিশালী ও নির্মম নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে ছাত্র-তরুণদের অগোছালো সশস্ত্রতা মোটেই টিকে থাকতে পারবে না। এ রকম প্রস্তাবকারীরা যে তথ্যের ওপর বেশি জোর দেন, তা হলো তাতমাদৌ হলো বিশ্বের একমাত্র সশস্ত্র বাহিনী, যারা লাগাতারভাবে ৭৫ বছর ধরে গেরিলা যুদ্ধ মোকাবিলার অভিজ্ঞতায় শক্তপোক্ত। কিন্তু একই তথ্য এ–ও প্রমাণ করছে, তারা দেশটির শান, কাচিন, কারেন, রাখাইন—কারও বিরুদ্ধে আজও পূর্ণাঙ্গ বিজয় পায়নি। কেবল মাঝে মাঝে কিছু খণ্ডযুদ্ধে জেতে মাত্র।

চিন প্রদেশের মিনদাতের এক তরুণের মন্তব্যটি এ ক্ষেত্রে বেশ অর্থবহ মনে হলো: ‘অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নয়, মূলত আমরা একটা বিশ্বাস নিয়ে প্রতিরোধে নেমেছি।’

মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির সামরিক বিশ্লেষণে এ–ও এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে, ইতিহাসে এই প্রথম তাতমাদৌর প্রধান জাতি বামারদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। এর সামরিক তাৎপর্য হলো, পুরো মিয়ানমারে বড়সড় প্রায় সব জাতি এখন তাতমাদৌর বিপক্ষে। এটা তাতমাদৌর জন্য বড় এক কৌশলগত সংকট।

দ্বিতীয়ত গেরিলা যুদ্ধের মৌলিক শর্ত জনসমর্থন। সেটা এই মুহূর্তে বামার তরুণদের পক্ষে আছে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, তাতমাদৌকে এখন পুরো মিয়ানমারে অত্যাচার, নিপীড়ন ও নজরদারি করেই কেবল টিকে থাকতে হবে। এর প্রধান এক সুবিধাভোগী হয়ে দাঁড়াচ্ছে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের পুরোনো গেরিলা অঞ্চলগুলো। তারা এই সুযোগে নিজ নিজ দখলের পরিসর কিছুটা বাড়াতে শুরু করেছে। তাদের এই অগ্রাভিযান শহর ছেড়ে পালাতে থাকা বামার বিক্ষোভকারীদের আশ্রয়ের নিরাপদ জোন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে করে কারেন, শান, কাচিনদের সঙ্গে বামারদের অভূতপূর্ব এক রাজনৈতিক মৈত্রীর সুযোগ তৈরি হয়ে গেছে সেখানে, যা তাতমাদৌর জন্য কৌশলগত দ্বিতীয় সংকট।

এটা সত্য, সংখ্যা ও অস্ত্র সম্পদে তাতমাদৌ পিডিএফ থেকে বহুগুণে এগিয়ে। কিন্তু ১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, প্রায় অপ্রস্তুত অবস্থা থেকে একটা গেরিলা যুদ্ধ শক্তিশালী নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারে জনসমর্থনের ওপর ভর করে। তবে বাংলাদেশের গেরিলারা যেভাবে ভারতের সহায়তা পেয়েছে, মিয়ানমারের বামার তরুণদের তেমন কোনো উৎস নেই এখনো। থাইল্যান্ড অতীতে মিয়ানমারের জন–আন্দোলনগুলোতে যে রকম সহায়ক ভূমিকায় ছিল, এবার একদম সেটা নেই। মিয়ানমারের চলমান প্রতিরোধ সংগ্রামের মূল দুর্বলতা এটাই।

তারপরও যে রেঙ্গুন ও মান্দালের রাস্তাঘাটে হুটহাট ক্ষণিকের ‘অ্যাকশন’ দেখা যাচ্ছে, তার কারণ মিয়ানমারের সংস্কৃতি। দেশটিতে সামরিক জ্ঞানের বিপুল সামাজিক ঐতিহ্য রয়েছে। তার ওপর ভর করেই সেখানে দেশীয় অস্ত্রের উৎপাদন বাড়তে দেখা যাচ্ছে এখন। চিন প্রদেশের মিনদাতের এক তরুণের মন্তব্যটি এ ক্ষেত্রে বেশ অর্থবহ মনে হলো: ‘অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নয়, মূলত আমরা একটা বিশ্বাস নিয়ে প্রতিরোধে নেমেছি।’ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের কাছের শহর মিনদাতে বেশ কয়েক মাস ধরে দেশীয় অস্ত্রের বড় এক প্রতিরোধ সামলাচ্ছে তাতমাদৌ।

স্থানীয় এসব সশস্ত্রতার বড় এক শক্তির জায়গা হলো পুরো গেরিলা প্রতিরোধ গড়ে উঠছে দেশের ভেতরে দাঁড়িয়ে, আত্মশক্তির ওপর ভর করে। তাতমাদৌ তাই কোনো দেশকে এর পেছনে ইন্ধনের জন্য দায়ী করতে পারছে না; বরং আশপাশের দেশগুলোতে মিয়ানমারের গেরিলা তরুণদের পক্ষে সহানুভূতি বাড়ছে। সে রকম সহানুভূতি কেজো সহযোগিতা হয়ে দাঁড়ালে চীন-রাশিয়ার সহযোগিতা তাতমাদৌর জন্য যথেষ্ট হবে না।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক