মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনটি নির্বিঘ্নে পার হওয়ার পর জাতীয় নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার প্রাথমিক আয়োজন মোটামুটি সম্পন্ন হলো বলা যায়। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী সব দলই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে আশা ও আনন্দের। কিন্তু এখনো সব ব্যাপারে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ ও নিরুদ্বেগ হওয়া যাচ্ছে না। এখনো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দ্বিতীয় শর্ত সাধারণ ভোটারদের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা নিয়ে যে বিরাজমান দ্বিধাদ্বন্দ্ব, তা কাটেনি।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত হিসেবে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট কিংবা অন্যান্য দল বা জোট যে দাবিদাওয়া দিয়েছিল, সরকার বা নির্বাচন কমিশন কেউ তা পূরণ করেনি। তারপরও সবাই নির্বাচনে আছে। এ বিষয়কে সরকার বা কমিশন তাদের সাফল্য হিসেবে ধরে নিয়ে কি তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে? আর কোনো দাবি না মানা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশগ্রহণকে কি বিএনপিসহ মহাজোটের বা সরকারের বাইরের সব দলের একধরনের পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে? বিষয়টি এ মুহূর্তে বোঝা জরুরি। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা কৌশল থাকবে। কিন্তু এখন থেকে নির্বাচন কমিশন এবং কমিশনের হাত, পা, চোখ, কান, নাক হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা, যাঁরা রিটার্নিং, সহ-রিটার্নিং, প্রিসাইডিং, সহ-প্রিসাইডিং, পোলিং কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কীভাবে দায়িত্ব পালন করেন, এসব বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নির্বাচন কমিশন মনোনয়নপত্র চূড়ান্তকরণ পর্যন্ত যে ভূমিকা পালন করেছে, তা জনমনে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে। তবে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর পর্যন্ত প্রতিমুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের পরীক্ষা দেওয়া শুরু হলো। এখানে প্রধান দুটি দিক কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়। এক. মাঠে বিচার বিভাগীয় যে কমিটিগুলো কাজ করছে, তাদের কাজে যথাযথ সহায়তা দেওয়া এবং তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলো ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা এবং কোথাও শিথিলতা দেখা গেলে টিম পরিবর্তন করা। দুই. পুলিশ বা নির্বাচনী কর্মকর্তার কোনো গাফিলতি বা বাড়াবাড়ি চিহ্নিত হলে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা বা অবস্থান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া।
পরিবেশ শান্তিপূর্ণ দেখা গেলেই তা সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বাভাস নয়। সাময়িক স্বস্তিও অন্তিম ফলাফল নয়। সে জন্য প্রথম প্রয়োজন নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনী অপরাধ ছাড়া অন্য কোনো কারণে কোনো নতুন গ্রেপ্তার যেন না হয় তা নিশ্চিত করা। কমিশন এ বিষয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারলে নির্বাচনে একটি সমতার পরিবেশ ফিরে আসতে পারে। এটি কোনো বড় চাওয়া নয়। আচরণবিধি ভঙ্গ বা নির্বাচনী অপরাধের অভিযোগ লিখিত, মৌখিক, গণমাধ্যম—যার মাধ্যমেই পাওয়া যাক না কেন, সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে যেন কোনো শিথিলতা না থাকে, সে নিশ্চয়তা দিতে হবে। এখানে একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন নতুন করে তোলার প্রয়োজন বোধ করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত গ্রাম প্রতিরক্ষা, আনসার, পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব; তাদের সাহায্যার্থে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। নির্বাচনে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছিল সরকারের বাইরের সবার ঐকমত্যের দাবি। এ বিষয়ে কমিশনের নিজস্ব মূল্যায়ন জানা এ মুহূর্তে ভীষণ জরুরি। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেনাবাহিনী ২৪ ডিসেম্বর থেকে মাঠে থাকবে। কিন্তু মাঠে তাদের কীভাবে কোন দায়িত্বে রাখা হবে, তা জানা আবশ্যক। সেনাবাহিনীর প্রতীকী ব্যবহার বা প্রতীকী উপস্থিতি কাম্য নয়। জনগণ সেনাবাহিনীর কার্যকর ও সক্রিয় ভূমিকা দেখতে চাইবে। আইনের চেয়ে এখানে গরজ বড়। সত্যিকারভাবে ভোটে গণ-অংশগ্রহণ চাইলে জনমনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। জনমনস্তত্ত্বে সেনানির্ভরতার একটা বৃহৎ ভূমিকা আছে এবং তার সংগত কারণও বিদ্যমান। নির্বাচন কমিশনের সেটি উপেক্ষা করা উচিত হবে না।
দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক, স্বাধীন গণমাধ্যম ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নির্বাচনকে স্বচ্ছ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের ব্যাপারে এর আগে কমিশন সচিবের মুখ থেকে যা শোনা গিয়েছিল, তা যেন মাঠে অনুসরণ করা না হয়। গণমাধ্যমকর্মীরা যেন স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রায় বিনা খরচে সিসিটিভির মতো ডিভাইস ব্যবহার সম্ভব। নির্বাচন কমিশন ইভিএম নিয়ে যত সময় ব্যয় করল, সিসিটিভির বিষয়টি নিয়ে কেন জানি কোনো মনোযোগ দিল না। পরিশেষে বলব, বিচার বিভাগীয় টিম, সেনাবাহিনী, গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের যথাযথ ভূমিকা পালন বাধাগ্রস্ত হলে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। নির্বাচনের সামনের দিনগুলোতে কমিশন পুরোদমে তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবে, সে প্রত্যাশা থাকল।
ড. তোফায়েল আহমেদ, রাজনীতি ও লোকপ্রশাসনের অধ্যাপক, স্থানীয় সরকার ও শাসন বিশেষজ্ঞ
tofail101@gmail.com