পরপর তিনজন বিদেশি নাগরিক নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। তাঁদের দুজন সাংবাদিক, তৃতীয়জন একজন সাহায্য সংস্থার কর্মী। ভিডিও ক্যামেরার সামনে খঞ্জর উঁচিয়ে তাঁদের গলা কেটে ফেলা হয়েছে। খুন করা হয়েছে আল্লাহর নামে, ইসলামের নামে, ইসলামিক স্টেটের (আদ-দাওলা-ই-ইসলামিয়া) নামে। সারা পৃথিবীর সভ্য মানুষ সে খুনের নিন্দা করেছে, কেবল আমরাই চুপ। নীরবতা যদি সম্মতির লক্ষণ হয়, তাহলে সে কথার অর্থ কি এই যে এই নৃশংস হত্যা আমরা সমর্থন করি?
যাঁরা ভাবছেন, আইসিস (ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া) বা আইএস (ইসলামিক স্টেট) নিয়ে আমাদের মাথাব্যথার কোনো কারণ নেই, এটা যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা, তাঁদের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করি। এখানে মুদ্রিত ছবিটি ভালোভাবে লক্ষ করুন। অথবা ইউটিউবে আইএস প্রচারিত ভিডিওটি আরেকবার দেখুন। এই নির্দয়তা ও বর্বরতা দিয়েই কি মুসলমান বাকি বিশ্বের কাছে পরিচিত হবে?
আফগানিস্তানে আল-কায়েদা ও তালেবানের উত্থান দেখে আমরা উদ্বিগ্ন হইনি, কিন্তু চোখ ফেলার আগেই সে বিপদ আমাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছিল। আল-কায়েদা থেকেই আইএসের উদ্ভব, কিন্তু আল-কায়েদার তুলনায় সে অনেক বেশি শক্তিধর ও ভয়াবহ। সিরিয়া ও ইরাকের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইতিমধ্যে এই দলের নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং সেখানে তারা নয়া খেলাফতের পত্তন করেছে। এই দলের মূল শক্তি এসেছে সাদ্দাম হোসেনের সেনাবাহিনীর সাবেক সুন্নি সদস্যদের কাছ থেকে। সাদ্দামের পতনের পর যে শিয়া সরকার ইরাকে মার্কিন তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে তাদের স্থান হয়নি। এবার তারা এককাট্টা হয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ার তেলের ওপর আংশিক নিয়ন্ত্রণ অর্জিত হওয়ায় এই দলের দৈনিক আয় প্রায় তিন মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বে এত ধনী জিহাদি গ্রুপ আর নেই, আগে কখনো ছিল না। আইএসের সাফল্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্নি জিহাদি সমর্থকদের মধ্যে বিপুল উৎসাহের সঞ্চার করেছে, দলে দলে তারা সিরিয়া ও ইরাকে আসছে নয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ নিতে।
মার্কিন ও ব্রিটিশ সূত্রগুলো জানিয়েছে, ৭৪টি দেশের অন্ততপক্ষে ১৫ হাজার বিদেশি জিহাদি আইএসে যোগ দিয়েছে। এরা যাচ্ছে, ভয় শুধু তা নিয়ে নয়। একসময় এরা যার যার দেশে ফিরে আসবে জিহাদি মন্ত্র নিয়ে এবং লঙ্কাকাণ্ড ঘটাবে। সন্ত্রাসী তৎপরতার জন্য পুরো এক বাহিনী মুজাহিদের প্রয়োজন নেই, এক বা দুজন হলেই চলে। আর ভয়টা সেখানে। স্বাভাবিকভাবে ভীত ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন ইতিমধ্যে আইএসে যোগ দিয়েছে তার দেশের এমন কোনো নাগরিক যাতে নিজ দেশে না ফিরতে পারে, সে ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে। একই চিন্তা যুক্তরাষ্ট্রেরও। এমনকি মুসলিমপ্রধান তুরস্ক ও তিউনিসিয়াও নিজ নাগরিকদের কীভাবে ঠেকানো যায়, সে ব্যাপারে সলাপরামর্শ শুরু করেছে।
আইএসের ভেতর-বাহির মৌলবাদী উত্থানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আগে থেকেই ক্ষতাক্ত। আইএসের সাফল্য সেখানে মৌলবাদীদের মধ্যে নতুন উৎসাহের সঞ্চার করবে। ‘খলিফা’ আবুবকর বাগদাদি দুই মাস আগে মসুলে নিজের খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করতে গিয়ে বলেছিলেন, বিশ্বের যেখানে একসময় মুসলিম রাজত্ব ছিল, আইএস সেখানেই কায়েম হবে। তিনি সরাসরি ভারতের নাম উল্লেখ করেছিলেন, কারণ সেখানে দীর্ঘদিন মুসলমানদের রাজত্ব ছিল। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করলেও এই দুই মুসলিমপ্রধান দেশও যে তাঁর টার্গেট, তাতে সন্দেহ নেই।
সবচেয়ে বেশি ভয় পাকিস্তানকে নিয়ে। দীর্ঘদিন থেকে সেখানে মৌলবাদী শক্তিগুলো সক্রিয়। অনেক ক্ষেত্রে সামরিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ২০০ মৌলবাদী গ্রুপ সেখানে তৎপর। ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ফল দাঁড়িয়েছে এই যে এখন পাকিস্তানের ৬০ শতাংশ মানুষ শরিয়াভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে। তার চেয়েও ভয়ের কথা, সে দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নাগরিকের মধ্যে জিহাদি আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন রয়েছে। আইএসের প্যান-ইসলামিজমের মন্ত্র অনেক মুসলমানকেই উজ্জীবিত করবে, বাগদাদ-বসরার স্বপ্ন তাদের নেশা ধরাবে। পাকিস্তান পিস স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোহাম্মদ আমির রানা সম্প্রতি করাচির ডন পত্রিকায় এক নিবন্ধে লিখেছেন, তালেবান দুর্বল হয়ে পড়েছে ও জিহাদি হুমকি সেখানে স্তিমিত বলে যারা মনে করে, আইএসের উত্থানে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। পাকিস্তানের ভেতরে তৎপর জিহাদি গ্রুপগুলোর আইএসের খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে শামিল হওয়া
খুবই স্বাভাবিক। শুধু আদর্শগত বা আর্থিক সমর্থন নয়, আইএস-অনুপ্রাণিত ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব খোরাসান’ প্রতিষ্ঠায় তারা সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে পারে।
ইরাক-পরবর্তী আল-কায়েদাভিত্তিক যে মৌলবাদী আন্দোলন, তার একটি আপাত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বক্তব্য আছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে হটে এসেছে বটে, কিন্তু তার আগ্রাসী চরিত্রের মৌল কোনো পরিবর্তন হয়নি। সম্ভবত সে কারণে আল-কায়েদা বা আইএস-জাতীয় চক্রের প্রতি আমাদের সমালোচনা কার্যত অনুপস্থিত। কিন্তু আল-কায়েদাপ্রভাবিত আন্দোলন যেখানেই দানা বেঁধেছে, তার আসল শিকার হয়েছে সেসব দেশের নিরীহ মানুষ। ইরাক, সিরিয়া অথবা মালি ও নাইজেরিয়ার দিকে তাকান। তাকান নিকটবর্তী পাকিস্তানের দিকে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেখানে মৌলবাদকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। আল-কায়েদা ও তার তালেবান সহযোগীরা সে রাষ্ট্রের ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। তার ফল হয়েছে এই যে অন্তর্ঘাতী সামরিক সংঘর্ষে সেখানে জনজীবন এখন বিপন্ন। প্রমাণ হিসেবে আমি ডন পত্রিকার একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের দিকে আপনাদের নজর টানব। রাফিয়া জাকারিয়া লিখেছেন, করাচির রাস্তায় এখন প্রতিদিন মানুষের লাশ। শিয়া-সুন্নি হানাহানিতে প্রতিদিন ‘করাচি এখন একটি মৃত মানুষের শহর। এখানে নিহত হয় দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষ, নিহত হয় রাজনৈতিক কর্মী। নিহত নাগরিকদের লাশ শহরের মর্গে পড়ে থাকে। যদি কেউ তাদের শনাক্ত করতে না আসে, তাহলে জনকল্যাণকর্মীরা কাফনের কাপড়ে জড়িয়ে তাদের কবর দেন। তাদের কথা কেউ মনেও রাখে না।’ শুধু করাচি নয়, রাজধানী ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডিতে এই বছরে যে সংখ্যায় মানুষ ধর্মীয় হানাহানিতে নিহত হয়েছে, তা আগের ১০ বছরের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি।
মৌলবাদের সহিংস চরিত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, ফলে উদ্বিগ্ন আমাদেরও হওয়া উচিত। সামাজিক তথ্যমাধ্যমে ইতিমধ্যে ইসলামিক স্টেটের পক্ষে প্রচারণা শুরু হয়েছে। বাংলায় ই-মেইল চালাচালি শুরু হয়েছে। যাঁরা মনে করেন মৌলবাদী এই উত্থান আমাদের স্পর্শ করবে না, তাঁদের শুধু পাকিস্তানের উদাহরণটি মাথায় রাখতে বলি।
আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নতুন যে কোয়ালিশন গড়ার চেষ্টা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত তার জন্য অর্থ, অস্ত্র ও লোকবল আসছে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে। মার্কিন কমেডিয়ান জন স্টুয়ার্ট ঠাট্টা করে বলেছেন, এই কোয়ালিশনের বর্তমান চেহারা বড় বেশি ‘খ্রিষ্টান’। কথাটা মিথ্যা নয়। আরব ও মুসলিম দেশগুলো মুখে মুখে তাদের সমর্থন জানিয়েছে বটে, কিন্তু বাস্তবে সে সমর্থন কত দূর কাজে আসবে, তা পরিষ্কার নয়। পশ্চিমের সমর্থনে যেকোনো অভিযানে অংশগ্রহণে তাদের স্বভাবতই দ্বিধা রয়েছে। কিন্তু আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই একা পশ্চিমের হাতে ছেড়ে দিলে তা কখনোই সফল হবে না। এই লড়াই শুধু সামরিক নয়, আদর্শগত। সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পশ্চিমের জিত হলেও আদর্শগত যুদ্ধে সে বিজয় অসম্ভব।
শুদ্ধ ইসলামি রাজত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আইএস আমাদের দেড় হাজার বছর আগে ফিরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সে আমন্ত্রণের জবাবে আধুনিক, বহুপক্ষীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে পাল্টা ন্যারেটিভ নির্মাণের দায়িত্ব আমাদের। এই কাজে বিলম্ব হলে তার খেসারত আমাদেরই ভোগ করতে হবে।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।