আর্থুর ভাগনার দল ছাড়লেন। ব্যক্তিগত কারণের কথা বলে জার্মানির চরম ডানপন্থী ও ইসলামবিদ্বেষী দল অলটারনেটিভ ফুওর ডয়েচল্যান্ডের প্রথমসারির এই নেতা দল থেকে চলতি মাসের ১১ তারিখ পদত্যাগ করেছেন। দলত্যাগের জন্য ব্যক্তিগত কারণের কথা বলা হলেও সম্প্রতি খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষাগ্রহণই যে এর কারণ, সেটি এখন অনেকটাই বোধগম্য। জার্মানির বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আর্থুরের দলত্যাগ ও নতুন ধর্ম গ্রহণ বেশ সাড়া ফেলেছে। নানাভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা চলছে, আর্থুর কেন ধর্ম পরিবর্তন করলেন। কিন্তু আর্থুর মুখে তালা মেরে আছেন। তিনি এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। কোনো প্রলোভনে পড়ে ধর্ম পরিবর্তন করলেন? নাকি তিনি কোনো উগ্রপন্থীদের খপ্পরে পড়েছেন? অথবা তিনি নেহাত ইসলামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই নতুন ধর্ম গ্রহণ করলেন। এসব নিয়ে পরবর্তী সময়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
তবে আর্থুরের ধর্মান্তর ও এ বিষয়ে অন্যদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে জার্মান রাজনীতির বর্তমান চলনটা বোঝা যায়। জার্মান রাজনীতির অন্যতম আলোচিত দুটি বিষয় হচ্ছে শরণার্থী অভিবাসন ও ইসলামের প্রসার। গত সেপ্টেম্বরে নির্বাচনরে পর সরকারের গঠনে এতটা বিলম্বের কারণও কিন্তু আর্থুরের সদ্য সাবেক দল এএফডির উত্থান বা শরণার্থী ও ইসলামের প্রসার নিয়ে জার্মানদের মধ্যকার মতভেদ। কীভাবে? চরম অভিবাসী ও ইসলামবিরোধী প্রচারণা চালিয়েই এএফডি প্রথমবারের মতো জার্মান পার্লামেন্ট বুন্ডেসটাগে প্রবেশ করেছে। নির্বাচনে দলটি ১২ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট লাভ করে। শরণার্থী ও ইসলামবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে এএফডির এই উত্থান উদারপন্থী দলগুলোকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। কারণ, চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের দল খ্রিষ্টান গণতান্ত্রিক দল (সিডিইউ) বা মার্টিন শুলজের সামাজিক গণতন্ত্রী দল (এসপিডি) কেউই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সিডিইউ ও এসডিপি মিলে সরকার গঠন করলে এএফডি বুন্ডেসটাগে প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হবে। কারণ, অন্য দলগুলো এএফডির থেকে কম ভোট পেয়েছে। তাই নির্বাচনর পরপরই মার্টিন শুলজ ম্যার্কেলের সঙ্গে কোয়ালিশনে যেতে চাননি। তবে সিডিইউ কয়েক দফা সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার পর এসডিপি-সিডিইউ একসঙ্গে সরকার গঠনে সম্মত হয়েছে। তাই এএফডি এখন সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হবে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছিলেন, প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসলে এএফডির সমর্থনের পালে আরও জোর হাওয়া লাগবে। চরম ডানপন্থীদের উত্থানে যখন অনেকেই নড়েচড়ে বসছেন, ঠিক তখনই চমকে দেওয়ার মতো একটা খবর এল; আর্থুর দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। একেবারে বিপরীত শিবিরের ধর্মে দীক্ষাও নিয়েছেন। নিতান্তই ব্যক্তিগত বলে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি তিনি। এরপর তাঁকে প্রকাশ্যে খুব একটা দেখাও যায়নি। আর্থুর এএফডির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে গির্জা ও ধর্মীয় কমিউনিটির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি নিজেও ইসলাম ধর্মবিরোধী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন সক্রিয়ভাবে। তবে রাশিয়ান বংশোদ্ভূত এই এএফডি নেতার মধ্যে কিছুদিন ধরেই পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছিল। তিনি এএফডিতে খ্রিষ্টান ও সমকামীদের পাশাপাশি মুসলিমদের অধিকার ও আগ্রহ নিয়ে কথা বলে—এমন গোষ্ঠীগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর দলকে জাতিবিদ্বেষ থেকে বের হয়ে আসার পরামর্শও দেন।
জার্মানি চেষ্টা করছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে শুরু হওয়া এই জাতিবিদ্বেষী রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসার। ব্যাপক হারে শরণার্থীদের আগমন ও সন্ত্রাসী হামলা আবার জাতিবিদ্বেষকে উসকে দিচ্ছে। বিশেষ করে মুসলিম শরণার্থীদের নিয়ে জার্মান রাজনীতি এখন স্পষ্টতই দুই শিবিরে বিভক্ত। শরণার্থীবিরোধী শিবিরের নেতৃত্বে রয়েছে এএফডি। গত বছরের জুনে নির্বাচনী প্রচারে আর্থুর মন্তব্য করেছিলেন, চ্যান্সেলর হিসেবে ম্যার্কেল শরণার্থীদের ঢুকতে দিয়ে মহা ভুল করেছেন। নির্বাচনে এর হিসাব ম্যার্কেলকে দিতে হবে। এবং তিনি এও বলেছিলেন, ইসলাম জার্মানির ঐতিহ্যকে বহন করে না।
অনেক দিন ধরেই বলাবলি হচ্ছে, এসব প্রচারণার কারণে জার্মানিতে জাতিবিদ্বেষী দলগুলোর সমর্থন বাড়ছে। সর্বশেষ নির্বাচনে জার্মানির পূর্বাংশে সামাজিক গণতন্ত্রীরা এএফডি থেকে কম ভোট পেয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণেও ক্রমে এএফডির সমর্থন বাড়ছে; বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। জার্মানদের মধ্যে দলীয় সমর্থনে বয়সের একটি প্রাধান্য ছিল। এত দিন দেখা গিয়েছে, অপেক্ষাকৃত বয়স্করা খ্রিষ্টান গণতন্ত্রীদের সমর্থন করতেন। তরুণেরা ছিলেন সামাজিক গণতন্ত্রীদের সমর্থক। এখন তরুণেরা আর ঠিক আগের মতো সামাজিক গণতান্ত্রিকদের সমর্থন করছেন না। নির্বাচনে পরাজয়ের পর মার্টিন শুলজ নিজেও এ কথা বলেছেন। তরুণদের কিছু অংশ সবুজ দলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে; সংখ্যায় কম হলেও। আর বড় অংশ ঝুঁকছে এএফডির দিকে। এই বেকার তরুণদের মধ্যে শরণার্থীবিরোধী মনোভাবও সক্রিয় হচ্ছে। কারণ, এদের বড় একটি অংশই মনে করে, অধিক হারে শরণার্থী নেওয়ার কারণে তাদের বিভিন্ন সুবিধায় টান পড়তে পারে। অর্থনৈতিক ইস্যুকে পুঁজি করে দক্ষিণপন্থী দলগুলো জনসমর্থন নিজেদের দিকে টেনে নিচ্ছে। এর প্রভাবও পড়ছে রাজনীতিতে।
পশ্চিমের দেশগুলোয় নির্বাচনে সর্বত্র একই ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনে চরম দক্ষিণপন্থী দলগুলো অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো ফল করছে। এরপর সবাই বসে যাচ্ছে, কেন ডানপন্থীরা ভোট পাচ্ছে, সেই বিশ্লেষণ করতে। উত্তর খোঁজা হচ্ছে, কেনইবা মধ্যপন্থীদের জনপ্রিয়তা আর আগের মতো নেই। অবশ্য এর বিপরীত চিত্রও আছে। আর্থুরের মতো লোকজন আবার বহুপক্ষীয় সমাজের দিকে ফিরেও আসছেন। এখানে আর্থুর ধর্মান্তরিত হয়েছেন, এটি যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, আর্থুর নিজেই তাঁর সাবেক দলের মধ্যে সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন। এটিই বহুপক্ষীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সৌন্দর্য। আমরা যদি ইউরোপের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে, এখানকার ধর্মনিরপেক্ষতা সর্বধর্মীয় সংযুক্তিমূলক বহুপক্ষীয় এক সমাজ গঠনের দিক নির্দেশ করে। যেখানে সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। অবশ্যই অন্যের ক্ষতি না করে। সেই সমাজে সবার কথা শোনা হবে। কাউকে বাতিল বা খারিজ করে দেওয়া হবে।
ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোর অনেক সমালোচনাই রয়েছে। এটিই স্বাভাবিক। যুক্তি, তর্ক, সমালোচনার মধ্য দিয়েই সমাজ এগিয়ে যাবে। এরপরও ইউরোপিয়ান গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হচ্ছে অন্যের মতকে প্রকাশের সুযোগ দেওয়া। এখানে বিরোধী মতকে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে মোকাবিলা করা হয়। দমন বা পীড়ন করে নিশ্চিহ্ন করার মধ্যযুগীয় চেষ্টা নেই। যদি তা-ই হতো, তাহলে ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই এখন সাধারণ নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা হতো এই বলে যে নির্বাচন দিলেই চরম ডানপন্থীরা ক্ষমতায় এসে যাবে। বরং তা না করে এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো ডানপন্থী সমর্থকদের কথা শোনার চেষ্টা করছে। সমাজের সমস্যার কারণ কী, তা খুঁজে বের করছে। নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে।
ইউরোপের সহনশীল এই রাজনীতির সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে আর্থুরের ধর্মান্তরের ঘটনা। চরম ডানপন্থী হওয়ার পরও আর্থুরের দল এএফডি তাঁর ধর্মান্তরের বিষয়টি গ্রহণ করে জানিয়েছে, জার্মানির সংবিধান অনুসারে যেকোনো ব্যক্তির ধর্ম বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে। এটি নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। আর্থুরের চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে। যদিও দলটির ওয়েবসাইটে এখনো লেখা রয়েছে, বহুমাত্রিক সংস্কৃতি-সামাজিক শাস্তি ও ঐক্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এরপরও দলটির সবাই মিলে আর্থুরের ওপর হামলে পড়েনি বা তাঁকে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী বলে এখনো চিহ্নিত করেনি। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও আর্থুরের ধর্মান্তরের বিষয়ে তেমন কোনো মন্তব্য করেছে বলে জানা যায়নি।
অনেকেই মনে করছেন, আর্থুরের ইসলাম গ্রহণ প্রকৃতপক্ষে কী নির্দেশ করে? মোটাদাগে বলা যায়, আর্থুরের ধর্মান্তর এবং সবার সেটি মেনে নেওয়া ইউরোপের সহনশীল ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে নতুন মাত্রা যোগ করবে। আর্থুর হয়তোবা একজন ব্যক্তি। তিনি কোন ধর্মে গেলেন, সেটি বিবেচ্য নয়। কিন্তু আর্থুর আপাত জাতিবিদ্বেষ, জোনোফোবিয়াকে প্রত্যাখ্যান করলেন, এর মধ্যে নতুন এক ইউরোপের ইঙ্গিতও আছে।
ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জর্মানি।