মতামত

ইসরায়েলি আগ্রাসনে যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনি শিশুদের শৈশব

ইসরায়েলের আগ্রাসনে ফিলিস্তিনি শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা ও ভীতির বোধ জন্ম নিচ্ছে
ছবি : এএফপি

গত বছর ইসরায়েলের কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ১০৪ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনটি বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়া ইসরায়েলি সৈন্যের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি। এর শিরোনাম ‘জীবনের প্রকাশ’। প্রতিবেদনটিতে দখলকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে আগ্রাসনের সময় কী রকম সহিংসতা চালানো হয়, সেটার চাক্ষুষ ও বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ভোররাতে আচমকা এ রকম আগ্রাসনে শিশু, নারী ও পুরুষের ওপর যে গভীর মনস্তাত্ত্বিক এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়, সেটার প্রমাণও সেখানে আছে।

ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর এ রকম একটি আগ্রাসনের ঘটনায় ফিলিস্তিনি একটি পরিবার কীভাবে নিজেদের রক্ষা করছে, সে রকম একটা ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওটি খুব সংক্ষিপ্ত, কিন্তু পুরো একটি ঘটনা পরিপূর্ণভাবে বোঝার জন্য যথেষ্ট। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলি সৈন্যরা যে নিষ্ঠুরতার প্রদর্শন করছে, সেটা অভূতপূর্ব। এ রকম নিষ্ঠুরতা আমাদের প্রাণ-মন ও আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত ও ক্রুদ্ধ করে। এটা ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুদের ওপর চালানো ইসরায়েলি বাহিনীর অত্যাচারের একটি নমুনা।

হেবরনে ফিলিস্তিনি একটি বাড়িতে এ আগ্রাসনের ঘটনাটি ঘটেছে এ বছরের ৩ সেপ্টেম্বর। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত একদল ইসরায়েলি সৈন্য ফিলিস্তিনি একটি বাড়িতে ঢুকে পড়ে। হাতে মোবাইল ধরা একজন ফিলিস্তিনি নারী বলছেন, তিনি ইসরায়েলভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থায় কাজ করেন। তাঁর পরিচয় পাওয়ার পরও ইসরায়েলি সৈন্যরা সেখান থেকে ফিরে আসেনি।

একজন সৈন্য সব শিশুকে এক জায়গায় জড়ো হওয়ার আদেশ দিচ্ছিল। শিশুরা টি-শার্ট পরা ছিল, তাদের চোখেমুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ। শিশুদের অনেককেই ঘুম থেকে টেনে তোলা হয়েছিল। একটি মেয়ে হাত দিয়ে মুখ লুকাচ্ছিল। অন্য আরেকটি মেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আরেকজন বুকের সঙ্গে হাত আড়াআড়ি রেখে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। ছোট বাচ্চাসহ মোট ১৬ জন শিশু সেখানে ছিল। আগ্রাসনকারীরা ক্যামেরা এমনভাবে ধরে ছিল যেন শিশুরা কোনো খোঁয়াড়ের ভেড়ার পাল।

একজন সৈন্য সব শিশুকে এক জায়গায় জড়ো হওয়ার আদেশ দিচ্ছিল। শিশুরা টি-শার্ট পরা ছিল, তাদের চোখেমুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ। শিশুদের অনেককেই ঘুম থেকে টেনে তোলা হয়েছিল। একটি মেয়ে হাত দিয়ে মুখ লুকাচ্ছিল। অন্য আরেকটি মেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আরেকজন বুকের সঙ্গে হাত আড়াআড়ি রেখে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। ছোট বাচ্চাসহ মোট ১৬ জন শিশু সেখানে ছিল। আগ্রাসনকারীরা ক্যামেরা এমনভাবে ধরে ছিল যেন শিশুরা কোনো খোঁয়াড়ের ভেড়ার পাল।

আগ্রাসনকারীদের দাবি, পাথর ছোড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই বাড়িতে তাদের অভিযান। কিন্তু এই অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট। মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন থেকেই এটা স্পষ্ট যে ইসরায়েলের সৈন্যরা আইনবহির্ভূতভাবে এ ধরনের অভিযান চালায়। তাদের কাছে তল্লাশির কোনো বৈধ অনুমতি থাকে না। এ অভিযানের পেছনে স্পষ্ট একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে ফিলিস্তিনি শিশুদের মনে আরও ভয় ও অনিশ্চয়তা বোধ তৈরি করে দেওয়া।

আগ্রাসনকারী একজন সৈন্য তার মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত শিশুদের ছবি তুলছিল। ওই বাড়ির একজন সদস্য এর প্রতিবাদ করছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘তোমার বাড়িতে যখন সৈন্যরা যাবে আর তোমার শিশুদের ছবি তুলবে, তুমি কি সেটা সহ্য করবে?’ সেই সৈন্যটা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছিল না, তার মুখে আত্মগর্বী ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। সৈন্যটি ভালো করেই জানে যে যতক্ষণ তার হাতে বন্দুক আছে, ততক্ষণ ক্ষমতা তার হাতেই। এই ক্ষমতা যেমন বলপ্রয়োগের, আবার তেমন ভয় দেখানোর।

আক্রমণকারীদের প্রকৃত নিষ্ঠুর চরিত্র শিগগিরই আরও সুস্পষ্ট করে প্রকাশ পেল। ভয়ে জড়সড় শিশুদের দিকে বুড়ো আঙুল তুলে হাসিমাখা কণ্ঠে একজন সৈন্য বলে উঠল, ‘পনির চাই’। শিশুদের সঙ্গে এ আচরণ যে কারও হৃদয় ভারাক্রান্ত করে তুলবে। কিন্তু ইসরায়েলি আগ্রাসনকারীদের এই নিষ্ঠুরতা শ্রেষ্ঠত্ববোধ ও দায়মুক্তি থেকে জন্ম নিয়েছে। আগ্রাসনকারী সৈন্যরা জানে যে অস্ত্র ও জাতীয়তা তারা বহন করে, সেটার বলেই ফিলিস্তিনি শিশুদের সঙ্গে যা খুশি তা-ই করার অধিকার তারা রাখে। অধিকাংশ ইসরায়েলি তাদের সৈন্যদের এই নিষ্ঠুরতার সপক্ষে দাঁড়াবে কিংবা নিষ্ঠুর ঘটনা যখন ঘটবে, তাতে করতালি দিয়ে উৎসাহিত করবে।

ইসরায়েলি সৈন্যরা যখন ফিলিস্তিনি শিশুদের ‘পনির চাই’ কি না, জানতে চাইছিল, তখন ফিলিস্তিনি এক মায়ের কাছ থেকে সুকঠোর প্রতিবাদ এল। চিৎকার করে তিনি বললেন, ‘না।’ কয়েকটি শিশু এতই ছোট ছিল যে সৈন্যরা যে তাদের অবজ্ঞা ও অপমান করছে, সেটা বোঝার বয়স তাদের হয়নি। আরেকবার ফিলিস্তিনি ওই মা চিৎকার করে বললেন, ‘না।’ এবার আগ্রাসনকারী সৈন্যরা হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, ‘ওরা চাইছে।’ এরপর খুব জোরে একজন বলল, ‘পনির চাই?’ এবার কণ্ঠ প্রশ্নাতীতভাবে আদেশমূলক। শুধু ফিলিস্তিনি ওই পরিবারের ওপর নয়, সব ফিলিস্তিনির নিয়তির ওপরই যেন এ আদেশ।
গত সেপ্টেম্বর মাসের ওই আগ্রাসন কিংবা তার আগে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে আগ্রাসন চালানোর হাজার ঘটনাতে যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে ইসরায়েলি সৈন্যরা, সেটা স্বীকার করার মতো কোনো ইসরায়েলি পাওয়া বিরল। বিভিন্ন দেশে তাদের সমর্থনকারীদের মধ্যেও এটা স্বীকারের মনোবৃত্তি নেই। তারা বরং ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো সৈন্যদের এ ধরনের অপরাধের জন্য শিশুদেরই দায়ী করে। ইসরায়েলের মানবাধিকার সংস্থাগুলো সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিত নিষ্ঠুরতার তথ্যপ্রমাণ হাজির করার পরও কোনো ব্যবস্থা তারা নেয় না। কিন্তু এগুলোর সবগুলোই অপরাধ।

বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে এই আগ্রাসনের ঘটনা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা ও ভীতির বোধ জন্ম নিচ্ছে। ঘর যেখানে তাদের নিশ্চয়তা আর আনন্দের উৎস হওয়ার কথা, তার বদলে ভীতি তাদের তাড়া করে ফিরছে। এর ফলাফল হচ্ছে, শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহ হারাচ্ছে, তারা চুপচাপ, বিষণ্ন কিংবা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বে শিশুরা যেখানে গড়ে ৬ দশমিক ৮ থেকে ১২ দশমিক ২ শতাংশ পিটিএসডিতে (পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার) ভুগছে, সেখানে ফিলিস্তিনি শিশুদের মধ্যে এ হার ৩৪ দশমিক ১ থেকে ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ।

আন্দ্রে মিত্রাভিচ আল-জাজিরার কলাম লেখক
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ