মতামত

ইরান কি ছদ্ম সামরিক শাসনের দিকে যাচ্ছে

হোসেন দেহঘানি
হোসেন দেহঘানি

ইরানের রজনীতিতে সরকার কট্টরপন্থায় ফিরে যাবে—এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আয়াতুল্লা আলী খামেনির সময় পর্যন্ত রাজনৈতিক বিভাজন খুব বেশি দৃশ্যমান ছিল না। তাঁর পরবর্তী যুগে সংস্কারপন্থী ও কট্টরপন্থীদের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। তাদের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এখন সংস্কারপন্থী ও বিপ্লবী গার্ডের ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।

আগামী জুনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিয়ে লড়াই আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে বিপ্লবী গার্ডের সাবেক সদস্যদের সংখ্যাই বেশি। আলোচনায় এগিয়ে আছেন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনির সামরিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেন দেহঘানি। বিপ্লবী গার্ডের সাবেক প্রধান জেনারেল মোহসেন রেজাইও আলোচনায় আছেন। দুজনেরই ইরান-ইরাক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে এবং ধারণা করা হচ্ছে উভয়েই কট্টরপন্থীদের সমর্থন পাবেন। কেউই কট্টরপন্থী বা সংস্কারপন্থীদের সঙ্গে যুক্ত নন, তবে দুজনই ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতির কঠোর সমালোচক।

এ ছাড়া জেনারেল রেজাই আয়াতুল্লা আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ ও আশীর্বাদপ্রাপ্ত। এই দুজনের বাইরে সাবেক ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সের প্রধান ও পশ্চিমের সঙ্গে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে দর-কষাকষিবিষয়ক টিমের সদস্য সায়িদ জালিলিও কট্টরপন্থীদের পক্ষ থেকে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তিনি পররাষ্ট্রনীতি বিষয়েও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। জালিলি প্রেসিডেন্ট হলে ইরানের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি দক্ষ হাতে সামলাতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া আরও এক জেনারেল সামরিক বাহিনী থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে কট্টরপন্থী শিবিরের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে বিপ্লবী গার্ডের সাবেক কর্মকর্তাদের সংখ্যাই বেশি।

স্বভাবতই সাবেক জেনারেলদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না সংস্কারপন্থী নেতারা। সাংবিধানিক কোনো বিধিনিষেধ না থাকলেও প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিসহ অনেকেই চাইছেন না ভবিষ্যতে সামরিক বাহিনীর জেনারেল দ্বারা ইরান শাসিত হোক। প্রেসিডেন্ট রুহানি সামরিক কর্মকর্তাদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

সাবেক জেনারেলদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের সমালোচনা করলেও সংস্কারপন্থী শিবির এখনো প্রার্থী নির্ধারণ করতে পারেনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ আলোচনায় ছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালের নির্বাচন দিয়ে সমালোচনার জন্য খাতামির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আর জাভেদ জারিফের আগ্রহ নেই নির্বাচন নিয়ে। ফলে, সংস্কারপন্থীদের পক্ষ থেকে এই দুজনের প্রার্থী না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। স্পিকার আলী লারিজানি সংস্কারপন্থীদের পক্ষ থেকে লড়তে পারেন। তিনি কট্টরপন্থী হিসেবে রাজনীতি শুরু করলেও সম্প্রতি সংস্কারপন্থীদের দলে ভিড়েছেন।

মোহসেন রেজাই

ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটারদের কাছে দুটি বিষয় গুরুত্ব পাবে। একটি হচ্ছে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্তভাবে রুখে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন। আরেকটি হচ্ছে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তন করা। এদিক থেকে কট্টরপন্থী প্রার্থীরা সংস্কারপন্থীদের থেকে এগিয়ে আছেন। কট্টরপন্থীরা একদিকে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করছেন, অন্যদিকে হাসান রুহানিকেও তুলোধোনা করতে ছাড়ছেন না।

ভোটাররা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের নির্বাচনে গভীরভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের নিরাপত্তা, ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়ার স্থিতিশীলতা ও রাজনীতি অনেকটাই ইরানের আঞ্চলিক কৌশলের ওপর নির্ভরশীল। তাই পশ্চিমারা নানাভাবে ইরানের ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত ও গবেষণা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাংকগুলো কোমর বেঁধে নেমেছে। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট প্রচার করছে বিপ্লবী গার্ডের সাবেক সদস্যরা প্রার্থী হিসেবে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ বিজয়ী হলে ইরান ছদ্ম সামরিক শাসনের অধীনে চলে যাবে।

ফেব্রুয়ারিতে আটলান্টিক কাউন্সিল ম্যারিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি পরিচালিত একটি জরিপ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে ইরানিদের মনোভাব বদলে যাচ্ছে। জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি মাসে পরিচালিত ওই জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, ২৯ শতাংশ ইরানি নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে শত্রু বলে বিবেচনা করেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে ৭০ শতাংশ ইরানি যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রু বলে মনে করতেন।

তবে ৮৩ শতাংশ নাগরিক এখনো যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। ওই জরিপে আরও বলা হয়েছে, ইরানিরা তাঁদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার থেকে হাসান রুহানির ভুল নীতি ও দুর্নীতিকে দায়ী বলে মনে করেন। ৬৪ শতাংশ ইরানি মনে করেন, পরবর্তী প্রেসিডেন্টকে রুহানির নীতির আমূল পরিবর্তন করতে হবে।

ইরাক ও সিরিয়া ইরানের হাতে পর্যুদস্ত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিপ্লবী গার্ডকে দুর্বল করা। বিপ্লবী গার্ডই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ। বিপ্লবী গার্ডের জেনারেল সোলাইমানি একাই ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধের মানচিত্র বদলে দিয়েছিলেন।

যদি বিপ্লবী গার্ডের সাবেক কর্মকর্তা বা কট্টরপন্থী কেউ নির্বাচিত হন, তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্র খুব করে চাইছে সংস্কারপন্থী কেউ নির্বাচিত হোক। তাহলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদানের প্যাকেজ নিয়ে হাজির হতে পারে বাইডেন প্রশাসন। তবে শর্ত থাকতে পারে পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করা ও বিপ্লবী গার্ডের ক্ষমতা খর্ব করা। এই পথে একমাত্র বাধা আয়াতুল্লা আলী খামেনি।

২০১৩ সালেও বিপ্লবী গার্ডের একাধিক সাবেক কর্মকর্তা নির্বাচন করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু ওই সময় আলী খামেনির হস্তক্ষেপে দ্বন্দ্ব খুব বেশি প্রকট আকার ধারণ করতে পারেনি। বরং হাসান রুহানি জিতে বেরিয়ে আসেন। এবার আলী খামেনি এমনটা নাও করতে পারেন; বরং কট্টরপন্থী শিবির থেকে কেউ একজন নির্বাচিত হতে পারেন।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক