এপ্রিলে, পাকিস্তানি কলামলেখক সুহাইল ওয়ারাইখ বড় গলায় বলেছিলেন, আসন্ন জুনেই ইমরান খান সরকারের পতন ঘটবে। জুন এল এবং চলেও গেল। ইমরান খানও জায়গামতো রয়ে গেলেন। দলের ভেতর কোন্দল, বিবিধ রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি ফাঁস এবং সরকার চালাতে হিমশিম খাওয়া দেখে অনেকেই ইমরান খানের পতনের দিন গুনছিলেন। কেউ ভেবেছিলেন রাজনৈতিক ঝড় এসে ইমরানের সরকারকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। অনেকে সংসদীয় উদ্যোগের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে তার জায়গায় অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সম্ভাবনা দেখছিলেন।
পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর কল্যাণে কোনো প্রধানমন্ত্রীই মেয়াদ পুরো করতে পারেননি। খান হয়তো নাজুক, কিন্তু তাঁর পরিণতি পূর্বসূরিদের মতো হচ্ছে না। বরং তাঁরই মেয়াদের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার সম্ভাবনা জোরদার। বিরোধী দলের দুর্বলতা, খানের ব্যক্তিগত ও কৌশলগত সাফল্যের গল্প এবং সর্বোপরি সেনাবাহিনীর মদদ তাঁকে টিকিয়ে রাখছে। তবে পরিস্থিতির উত্তাপ তিনি টের পাচ্ছেন।
তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) অন্তর্কোন্দলের গুজব সত্য হয়ে ওঠে গত জুন মাসে। ইমরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী টেলিভিশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি, পরিকল্পনামন্ত্রী আসাদ উমর এবং জ্যেষ্ঠ পিটিআই নেতা জাহাঙ্গীর তারিনের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হন। পরপরই কোরেশি ও তারিন ইমরানের কাছে ফাওয়াদকে বরখাস্তের কথা তুলেছিলেন। ইমরান তা করেননি।
ভেতরের ঝগড়াঝাঁটির মধ্যেই প্রচারিত হয় দুটি বড় কেলেঙ্কারির খবর। জুন মাসে বিমানমন্ত্রী জানান, পাকিস্তানের ৯০০ পাইলটের তিন ভাগেরই বিমান চালানোর লাইসেন্স নকল এবং তাঁরা এ কাজে অযোগ্য। ইমরানের সমর্থকেরা যুক্তি দেন, এসব ইমরানের
আমলের আগের বাস্তবতা। কিন্তু পরের গোমর ফাঁস ছিল আরও মারাত্মক। সরকারের একটি সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন ফাঁস হলে জানা যায়, মন্ত্রী তারিন এবং পিটিআইবহির্ভূত কতিপয় ক্ষমতাসীন নেতা দুর্নীতি ও বাটপারির সঙ্গে জড়িত।
যেকোনো নেতার জন্যই এ ধরনের কেলেঙ্কারি অতি ভয়ানক। ইমরানের জন্য তা আরও ধ্বংসাত্মক এ জন্য যে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন করেই আপন ভাবমূর্তি গড়েছিলেন। এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এল করোনাভাইরাসের মহামারি। অর্থনৈতিক দুর্গতির সঙ্গে মিলে করোনাভাইরাস পাকিস্তানের জিডিপিকে ১–এর নিচে নামাবে বলে বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এসব ঘটনা ইমরানের অনভিজ্ঞ সরকারকে অযোগ্য এবং এ কারণে সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হিসেবে চিত্রিত করে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ইমরান অক্ষম, এমন মন্তব্য তাঁর দলের লোকেরাও করতে থাকে। জবাবে ইমরান বড় এক দল উচ্চ মানসম্পন্ন বিশেষ সহকারী নিয়োগ দেন।
পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, ইমরান মিত্র হারাচ্ছেন। মধ্য জুনে তাঁর কোয়ালিশনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দল পক্ষ ত্যাগ করে। খানের এ দুরবস্থা কাজে লাগিয়ে বিরোধী দলগুলো শক্তি সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু খানকে উচ্ছেদ করার মতো গণ-আন্দোলন জাগাতে তারা অক্ষম। তারা নিজেরাই বিভক্ত। আর ইমরান এখনো সামরিক বাহিনীর পেয়ারের লোক। যে দেশে সেনাবাহিনীর অনুমোদন না থাকলে কেউ ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে না, সেখানে এটা বিরাট বিষয়।
বলা হয়, খান সরকারি নীতিতে, বিশেষ করে সিভিল সরকারের অভ্যন্তরীণ কর্মসূচির বেলাতেও সেনাবাহিনীর প্রভাবের বিপক্ষে দাঁড়াননি। বিগত সময়ে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ (নওয়াজ) সরকার চলেছিল এর উল্টো পথে। ফলত, সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য বলে ঘোষণা করে এবং তাঁর সরকারের পতন হয়। বিপরীতে ইমরান খান বিদেশে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি উন্নত করার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর কাছে আরও প্রিয় হয়েছেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর পরে ইমরান খানই হলেন সবচেয়ে আকর্ষণীয় নেতা। আমেরিকা সফরে গিয়ে ইমরান যেভাবে প্রভাবশালী বিশ্বনেতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন, যেভাবে গত বছর ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনে কৌশলী আচরণ করেছেন—সেনাবাহিনী সেসবকে ভালোভাবে নিয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ইমরান খান ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর ঋণ মওকুফের প্রস্তাব তুলেছেন, অনেক দেশ সে জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
বিদেশে ইমরানের এসব সুকীর্তি দেশের ভেতরের ব্যর্থতাগুলোকে ম্লান করে দিয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলার যে চিত্র পাকিস্তান তুলে ধরেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানে নতুন সংক্রমণ ও মৃত্যুহার পড়তির দিকে। বিল গেটস ও মার্কিন কর্মকর্তারা এখন পাকিস্তানকে করোনা মোকাবিলায় সফলতার দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরছেন। সমস্যা নিয়েও খান হলেন সামরিক বাহিনীর নিরাপদ বাজি। তাদের সামনে ইমরানের কোনো বিকল্প নেই। সামনে রয়েছে আরও তিন বছরের মেয়াদ। পাকিস্তানের বাস্তবতায় অতি দীর্ঘ একটা সময়। আর প্রধানমন্ত্রীর আসনে রয়েছেন এমন একজন, যিনি সেনা প্রভাবকে প্রশ্ন করবেন না কিন্তু তাদের ভুলের বোঝা নিজের কাঁধে নিতে প্রস্তুত।
যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
মাইকেল কুগেলম্যান ওয়াশিংটনের উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারসের এশিয়া প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর