ইমরানকে হাত পাততেই হলো

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় এবার আইএমএফের দ্বারস্থ হলেন। ছবি: এএফপি
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় এবার আইএমএফের দ্বারস্থ হলেন। ছবি: এএফপি

ক্ষমতায় আসার আগেই ইমরান খান জানতেন সে কথা। জানতেন, প্রধানমন্ত্রী হলে পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে টেনে তোলার কঠিন চাপ নিতে হবে। এসব জেনেও নির্বাচনী প্রচারে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থার কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু নিরুপায় হয়ে এবার সেই সংস্থাগুলোর কাছে হাত পাতলেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে, ১২ মে ইমরানের সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছেছে। এই চুক্তি অনুযায়ী আগামী তিন বছরে পাকিস্তান সংস্থাটির কাছ থেকে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ পাবে। কিছু কঠিন শর্ত মেনে হলেও এই ঋণ নিতে রাজি হয়েছেন ইমরান। যদিও বিষয়টি চূড়ান্ত হবে আইএমএফের শীর্ষ কর্মকর্তা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্বব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর। ডয়চে ভেলের খবরে বলা হচ্ছে, এই চুক্তি চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা পাবে পাকিস্তান।

নির্বাচনী প্রচারে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে বলায় ক্ষমতা নেওয়ার পর এই সংস্থাগুলো থেকে দূরে থাকার চেষ্টাই করেছিলেন ইমরান। তাই শুরুতে ভরসা রেখেছিলেন বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর ওপর। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সৌদি আরবের কাছ থেকে ৬০০ কোটি ডলার, চীনের কাছ থেকে ২২০ কোটি ডলার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) কাছ থেকে ২০০ কোটি ডলারও পেয়েছেন ইমরান। ইউএই আরও কিছু অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চীনের ঋণ সহায়তার ক্ষেত্রে কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, পাকিস্তানকে ‘ঋণ-ফাঁদের কূটনীতিতে’ ফেলছে চীন। পাকিস্তানের সড়ক-মহাসড়ক, বন্দর ও বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট প্রকল্পে বিশাল বিনিয়োগ করছে চীন।

>
  • গত জানুয়ারিতে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬৬০ কোটি ডলার, যা দেশটির মাত্র এক মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান
  • ২০১৮ সালে রাষ্ট্রীয় তহবিলে ঘাটতি ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার
  • বর্তমানে বাণিজ্য ঘাটতি ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলারের ওপরে। যা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ
  • গত ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল পাকিস্তানে

অর্থনীতিকে টেনে তুলতে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সহায়তা নেওয়া ছাড়াও অভ্যন্তরীণভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন ইমরান। সরকারি ব্যয় সংকোচন, বড় গ্রাহকদের গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, ডলারের অবমূল্যায়ন (গত বছরের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি) মেনে নিয়েছেন তিনি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ পেতে যাচ্ছে পাকিস্তান। ছবি: রয়টার্স

এত কিছুর পরও বাজেট ঘাটতি মেটানো, আমদানি ব্যয় মেটানো ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিরাপদ রাখতে পারছে না ইমরানের সরকার। তাই অন্য কোনো উপায় না পেয়ে আইএমএফের কাছে হাত পাতলেন সরকারপ্রধান। আইএমএফের কাছে পাকিস্তানের ঋণ সহায়তা অবশ্য এটা নতুন নয়। সংস্থাটির কাছে এর আগে ২১ বার ঋণ নিয়েছে দেশটি। ঋণ নেওয়ার সংখ্যায় আর্জেন্টিনাই শুধু তাদের সমান। আইএমএফের এবারের ঋণ পাকিস্তানের তাৎক্ষণিকভাবে ডলারের ঘাটতি মেটাতে সহায়তা করবে। কিন্তু এর বিনিময়ে পাকিস্তান সরকারকে কর বাড়াতে হবে, সেবা খাতে (পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদি) দাম বাড়াতে হবে, বিভিন্ন খাতে দেওয়া সরকারের ভর্তুকি কমাতে হবে; প্রয়োজনে রুপির দাম কমাতে হবে। তবে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি চাপ কমাতে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ অব্যাহত রাখার পক্ষেই রয়েছে আইএমএফ।

আইএমএফের কাছে বারবার ঋণ নেওয়া পাকিস্তান প্রতিবারই বহু শর্ত মেনে চুক্তি করে। এর আগেও বিভিন্ন সময় পাকিস্তানকে করের আওতা বাড়ানো, সেবা খাতে মূল্যবৃদ্ধি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বাড়ানোর শর্ত দিয়ে ঋণ দেয় আইএমএফ। কিন্তু ইসলামাবাদ সব সময় সব শর্ত পূরণ করে না। এর আগের সরকারগুলো আইএমএফের পরামর্শ বাস্তবায়নে ইচ্ছাকৃতভাবেই ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েছিল। এর কারণ ছিল দেশটির অভ্যন্তরীণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে চটাতে চাইত না তারা। তবে এবারের ঋণের শর্ত পূরণে ইমরান খানের সরকারের কী ভূমিকা হবে, সেটা সময় হলেই বোঝা যাবে। আইএমএফের সাবেক উপদেষ্টা ইহতেশাম আহমেদ বলেছেন, ঋণ নেওয়ার সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন সময় আইএমএফের সঙ্গে ‘খেলেছে’, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আংশিকভাবে জয়ও পেয়েছে।

ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ভবন। ছবি: এএফপি

দ্য ডিপ্লোম্যাটের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইমরান খান ছয় থেকে আট মাস আগেও যদি আইএমএফের শরণাপন্ন হতেন, তখন হয়তোবা তিনি তুলনামূলক সহজ শর্তেই ঋণ পেতেন। এখন বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সহায়তা পাওয়ার পরও দুরবস্থা কাটাতে না পেরেই তিনি আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাই আইএমএফ সুযোগ বুঝে শর্ত কঠোর করার সুবিধা পেয়েছে। তবে ইমরান আইএমএফের ঋণ সহায়তা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তা না হলে তিন বছর পর আবারও ঋণ প্যাকেজের জন্য আইএমএফের কাছে হাত পাততে হবে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা অবশ্য ঘোষণা দিয়েছেন, এটাই হবে আইএমএফের কাছে নেওয়া পাকিস্তানের শেষ ঋণ সহায়তা প্যাকেজ। আইএমএফের সঙ্গে ৬০০ কোটি ডলারের এই চুক্তি চূড়ান্ত অনুমোদন হলে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছ থেকে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে। দেশটির রাজস্ব প্রতিমন্ত্রী হামাদ আজহার বলেছেন, এই ঋণ সহায়তা ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার ঘাটতি ভারসাম্য আনতে দারুণ সহায়ক হবে।

তবে বিশ্লেষকদের মত, এই ঋণ প্যাকেজ ও দাতাদের শর্ত মেনে ইমরানের ‘ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র’ গড়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ কঠিন হবে। ওয়াশিংটনভিত্তিক উড্রো উইলসন সেন্টার ফর স্কলারসের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, আইএমএফের এই প্যাকেজ ইমরান খানের দেওয়া অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণ কঠিন করে তুলবে। একই সঙ্গে তাঁর ভাবমূর্তিতে এর প্রভাব পড়বে।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকেও পাকিস্তান ঋণ পেতে পারে ৩০০ কোটি ডলার। ছবি: রয়টার্স

গত বছরের ১৮ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন ইমরান। সমালোচকেরা বলছেন, এই সময়ের মধ্যে তিনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নে বলার মতো কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি। সেটার প্রতিফলন দেখা যায় ৩১ মে প্রকাশিত সরকারি এক নথিতেও। তাতে বলা হয়, আট বছরের মধ্যে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। পাকিস্তানের দ্য নিউজ বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছে চলতি বছরের মধ্য জানুয়ারিতে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬৬০ কোটি ডলার, যা দেশটির মাত্র এক মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান। সৌদি আরব, চীন ও ইউএইর সহায়তার পরও সেই রিজার্ভ দ্বিগুণ করতে পারেনি দেশটি। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫০ কোটি ডলারে। নিজেদের ইতিহাসে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতিতে রয়েছে পাকিস্তান। যার পরিমাণ ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলারের ওপরে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অবস্থাও শোচনীয়—২০১৫ সালে দেশটির রাষ্ট্রীয় তহবিলে ঘাটতি ছিল ২৭০ কোটি ডলার, যা ২০১৮ সালে এসে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলারে। অর্থায়নের অভাব, বিদ্যুৎ না পাওয়া, ব্যবসার ব্যয় বেশিসহ বিভিন্ন কারণে দেশটিতে বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক কারণেই কমে গেছে বিদেশি বিনিয়োগও। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মূল্য দিচ্ছে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতির শিকার তারা। গত বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রী ইমরান দায়িত্ব নেওয়ার পর হয়তো ভেবেছিলেন, বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সহায়তাতেই তিনি অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবেন। সেটা করতে না পেরে নির্বাচনী প্রচারে যাদের তুলাধোনা করেছেন, সেই দাতাদের কাছে হাত পাততেই হলো তাঁকে।

মাহফুজার রহমান: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, প্রথম আলো
mahfuzer.sarker@prothomalo.com