মতামত

ইভিএম: রাজনৈতিক সংকটের সমাধান কারিগরি পথে নেই

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অচলাবস্থা এবং ভোট-ব্যবস্থার সংকটটি শতভাগ রাজনৈতিক। বিগত সিটি নির্বাচনের পর এক মেয়র প্রার্থী ইভিএম ভোটে কারচুপির অভিযোগ এনে ফলাফল বাতিল করার জন্য নির্বাচনী আদালতে যে আবেদন করেছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত সংশ্লিষ্টদের তলব করে নথি সরবরাহ করতে বলেন। তারপরও ইভিএম-সম্পর্কিত সব রেকর্ড, সিল, পোলিং কার্ড, অডিট কার্ড ও এসডি কার্ডের রেকর্ডিং, লগ বই, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তিদের তথ্য নির্বাচন কমিশন চাহিদামতো সরবরাহ করেনি। এ কারণে ইভিএমে ভোটে কারচুপির অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত করা যায়নি।

২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটের’ নির্বাচন কিংবা অপরাপর ভোট কারচুপির অভিযোগ কমিশন আমলে নেয়নি, গুরুতর সব অভিযোগের বিষয়ে নিজেরা স্বপ্রণোদিত কোনো উদ্যোগও নেয়নি। অতীতে রাজনৈতিক সংকটের আদালতি কিংবা আমলাতান্ত্রিক সমাধান কাজে আসেনি। সেই বিবেচনায় এই প্রশ্ন খুবই জরুরি যে, ভবিষ্যতেও রাজনৈতিক সংকটের কারিগরি সমাধান কোনো কাজে আসবে কি? রাজনৈতিক সংকটের রাজনৈতিক সমাধানই কাম্য। রাজনৈতিক সমাধানই টেকসই ও দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও দশের জন্য মঙ্গলজনক।

২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোটের আগেই সরকার গঠনের উপযোগী আসনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার পাস করেছিল। ২০১৮ সালের ভোটের আগের রাতেই ধুমধাম আয়োজনের মাধ্যমে ভোটবাক্স ভর্তি করা হয়েছে বলে ব্যাপক অভিযোগ আছে। এবার সরকারের ভরসার কেন্দ্রবিন্দু ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্র বা ইভিএম। ২০২৩ সালে রাজনৈতিক সংকটকে কি কারিগরি পদ্ধতিতে মোকাবিলা করা হচ্ছে?

২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোটের আগেই সরকার গঠনের উপযোগী আসনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার পাস করেছিল। ২০১৮ সালের ভোটের আগের রাতেই ধুমধাম আয়োজনের মাধ্যমে ভোটবাক্স ভর্তি করা হয়েছে বলে ব্যাপক অভিযোগ আছে। এখন আগামী নির্বাচন সামনে রেখে চারদিকে বলাবলি হচ্ছে, এবার আর সেসব দৃষ্টিকটু পথে নির্বাচন হচ্ছে না; বরং এবার সরকারের ভরসার কেন্দ্রবিন্দু ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্র বা ইভিএম। ২০২৩ সালে রাজনৈতিক সংকটকে কি কারিগরি পদ্ধতিতে মোকাবিলা করা হচ্ছে? ডিজিটাল সরকারের শেষ রক্ষাকবচ কি ডিজিটাল যন্ত্রই হতে যাচ্ছে? প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক সংকটের যৌক্তিক সমাধানে না গিয়ে কারিগরি কৌশলে মেটানোর পরিকল্পনা কতটা কাজে আসবে? যেখানে ভোটদানের কক্ষে সরকারদলীয় কেউ দাঁড়িয়ে থেকে পছন্দের বোতামটি টিপে দেন বা দিতে বাধ্য করেন, সেখানে সরকার সত্যি সত্যিই কি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব পক্ষকেই ধোঁকা দিতে সক্ষম হবে?

সরকার ইভিএম নিয়ে পুলকিত হলেও শুধু বিরোধী মহলে নয়, বরং বিশেষজ্ঞ মহলেও যন্ত্রটি নিয়ে জোরালো আপত্তি রয়েছে। অভিযোগ আছে, ইভিএম রিমোট হ্যাকিং করা যায়। ড. অ্যালেক্স হালডারমেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছেন, আমেরিকায় ইভিএম টেম্পারপ্রুফ নয়। এ কারণে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে ইভিএম নিষিদ্ধ। আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। জার্মানি ও ফিনল্যান্ডে আদালতের নির্দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইভিএম।

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, ভারতে ইভিএম জালিয়াতি জেনে যাওয়ার কারণে খুনের অভিযোগ এসেছে (ইভিএমের কারচুপি জানায় গোপীনাথ ও গৌরী খুন? ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, প্রথম আলো)। পৃথিবীর ৯০ শতাংশ দেশে ইভিএম পদ্ধতি নেই। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করেছে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল ভোট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। মূলত, ইভিএম নিয়ে বিতর্ক ও নানাবিধ জটিলতার কারণে উন্নত দেশগুলো ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে গেছে। ইভিএম নিয়ে পশ্চিমা দেশের একাধিক পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে, মূলত বলপ্রয়োগে পরিচালিত সরকারগুলোয় ইভিএম চাপিয়ে দেওয়ার সুস্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে।

ভোট গ্রহণের পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকায় বহু কাজ হয়েছে। সেখানে ইভিএম পদ্ধতিতে না যাওয়া হলেও ভোটার নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। সংস্কারের দর্শনটাই হচ্ছে নিখুঁত ভোটার শনাক্তকরণ নিশ্চিত করা। অর্থাৎ একজনের ভোট যাতে আরেকজন দিতে না পারে এবং জানতে না পারে। তারা জোর দিয়েছে দুই স্তরের শনাক্তকরণে। ডাকযোগে ঠিকানায় পাঠানো কিউআর কোডসংবলিত তথ্য ব্যাংক বা টিকিট এবং ভোটকেন্দ্রে সশরীর করা জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই সাপেক্ষে ব্যালট পেপার ইস্যু করা হয় সেখানে। অনলাইন ভোটিংয়েও আছে বহুস্তর নিরাপত্তা সুরক্ষা।

বিপরীতে বাংলাদেশে ভোটকেন্দ্র দখল ভোট জালিয়াতির প্রধানতম হাতিয়ার। এক স্তরের শনাক্তকরণের পরে দলীয় লোকেরাই বাটন টিপে ভোট দেওয়ার গুরুদায়িত্বটি নিয়ে নেয়। অভিযোগ আছে, মাঠ নিয়ন্ত্রণকারীরা ভোটের আগের বিরোধী এজেন্টদের বাড়ি গিয়ে ভয় দেখিয়ে আসে, এ কারণে তাদের পক্ষে ভোটের দিন কেন্দ্রে আসাই অনিরাপদ হয়ে পড়ে। পাশাপাশি আছে আরও দুটি গুরুতর সমস্যা। এক, সবার বায়োমেট্রিক তথ্যশালা ঠিক নেই। দুই, ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্রে প্রায়ই কৃষক ও শ্রমঘন কাজের জড়িত শ্রমিক ও বয়স্কদের আঙুলের ছাপ মেলে না। নতুন ভোটদানের পদ্ধতি বলে ইভিএমের প্রতি কিছু মানুষের উৎসাহ কাজ করে। তারপরও ভোটাধিকার হরণের ক্রমাগত দুর্বৃত্তপনায় ভোটের ওপরই তৈরি হয়েছে জনগণের চরম অনাস্থা। ঢাকায় ইভিএম ভোটকেন্দ্রে ভোটদানের অতি নিম্নহার (কেন্দ্রভেদে মাত্র ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ) এমনই হতাশাজনক ছিল যে এমনকি নির্বাচন কমিশনও তা লুকাতে পারেনি।

ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশন ইভিএম নিয়ে অতি উৎসাহী হলেও অনলাইন ভোট কিংবা ভোটকেন্দ্রে সিসি টিভি ক্যামেরার বাধ্যবাধকতা বিষয়ে একেবারেই নির্বিকার। নতুন সমস্যা সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট করার সরকারদলীয় চাপ। গণতন্ত্র উন্নয়নমূলক বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ইভিএমে ভোট গ্রহণ নিয়ে দুটি সুনির্দিষ্ট শঙ্কার কথা উল্লেখ করেছে। ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি গণমাধ্যমে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ইভিএমের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। একটি দুর্বলতা হলো, ভোটার ভেরিফাইয়েবল পেপার লোডেড ট্রেইল নেই, যেটা ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেখানকার ইভিএমে সংযুক্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে আপনি কাকে ভোট দিলেন, সেটা নির্ধারণ করা যায় এবং একই সঙ্গে ভোটের শেষে ভোট নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ভোট পুনর্গণনা করা যায়। বাংলাদেশে বিগত নির্বাচনে যে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ত্রুটি ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ইভিএম হচ্ছে একটা যন্ত্র, আমরা এই যন্ত্রকে যে নির্দেশ দেব, সেই কমান্ড অনুযায়ী এটা কাজ করবে। ইভিএমের কমান্ডে থাকবে আমাদের নির্বাচন কমিশন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়।’

ইভিএমের দুর্বলতা প্রসঙ্গে সুজনের বক্তব্য হচ্ছে, ‘আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে ভোটারদের শনাক্ত করা হয়। অনেকের আঙুলের ছাপ ইভিএম পড়তে পারে না। তাই কর্মকর্তাদের এই ইভিএমকে ওভাররাইট করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। তার মানে ভোটারের পরিচিতি যদি নির্বাচন কর্মকর্তা আপলোড করতে পারেন, ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রার্থী অনুপস্থিত থাকলে নির্বাচন কর্মকর্তা তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। এটা একটা ভয়াবহ বিষয়। ইভিএমের দুর্বলতা নিয়ে আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই স্বীকার করেছেন।’

বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ কিংবা বগুড়ার মতো অল্প কিছু নির্বাচনী এলাকা ছাড়া অধিকাংশ সংসদীয় আসনই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী ফলাফলের ভোটবিন্যাসে দেখা যায়, ৫০ শতাংশের বেশি আসনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে মোট ভোটের মাত্র ১০ শতাংশের মধ্যে। এ কারণে সঠিক বায়োমেট্রিক ডেটাবেইজ না থাকলে (অতি সম্প্রতি প্রায় কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধন তথ্য হারিয়ে গেছে), কৃষকসহ শ্রমঘন কাজে জড়িত শ্রমিক ও বয়স্কদের আঙুলের ছাপ না মিললে, অন্য কোনো জালিয়াতি না থাকলেও শুধু কর্মকর্তাদের ইভিএম ওভাররাইটই ফলাফল পরিবর্তনের প্রধানতম হাতিয়ার হতে পারে!

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের অনুষ্ঠানে গিয়ে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ইভিএমকে সুন্দর মেশিন বলে প্রশংসা করেছেন। তবে ২৯ মে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘মাঠের চিত্র যদি এমন হয়, যদি বিশ্বাস না থাকে, আস্থা না থাকে, তবে ইভিএম কেন, কোনো কিছু দিয়েই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। ভোটারের আঙুলের ছাপ দিয়ে ইভিএম ওপেনের পর আরেকজন যদি বাটন চেপে ভোট দিয়ে দেয়, সেই দায় তো মেশিনের নয়। এটা তো নির্বাচন ব্যবস্থাপনার বিষয়।’

ধারণা করি, বুয়েটের ডিজাইন করা, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি কিংবা ওয়ালটনের তৈরি করা হার্ডওয়্যার তাঁদের পছন্দ হয়েছে। ড. কায়কোবাদ ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘ইভিএম আমরা নিজেরা কিন্তু পরীক্ষা করে দেখিনি।’ ইভিএমের সফটওয়্যার আর্কিটেকচার, অপারেটিং সিস্টেম ও অ্যালগরিদমই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেহেতু ইভিএমে ব্যবহৃত সফটওয়্যারের ওপরই নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করে, তাই এই অংশের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে, তার পক্ষে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করা অত্যন্ত সহজ।

বাংলাদেশের ইভিএম কেন ঠিক সকাল আটটায় সুইচ অন করে সিংক করা লাগে, আগের সিংক করা ইভিএম কেন কাজ করে না, তার কারিগরি ব্যাখ্যা নেই। ইভিএমে ভিন্ন ভিন্ন অপারেটিং অ্যালগরিদম মুড আছে কি না, তা অজানা। ঠিক চারটায় মেশিন ভোট নেওয়া বন্ধ করে। মাঝে কারিগরি ত্রুটি কিংবা যন্ত্র হ্যাং করলে কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে কোনো সমস্যা হলে লাইনে অপেক্ষমাণ ভোটার ভোট না দিয়েই কেন ফিরে যাবেন—এসবের উত্তর নেই।

অস্ট্রেলিয়ান পাবলিক সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সাইফুর রহমানের মতে, ইভিএমের সঙ্গে সংযোজিত যেকোনো ইনপুট পোর্টের মাধ্যমে যন্ত্রটির ভেতর ম্যালওয়্যার-মলিকুলাস কোড প্রবেশ করিয়ে ভোটের ফলাফল বিকৃতি করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াই যন্ত্রটির ভেতরে গোপনে মুঠোফোনের সিম-জাতীয় আইসি (ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট) কিংবা গোপন যন্ত্রাংশ বা ডেটা এন্ট্রি পোর্ট সংযোগ স্থাপন করে দূর থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বাংলাদেশে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ডিজিটাল অডিট ট্রেইলের ব্যবস্থা আছে (এতে গোপনীয়তা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি আছে)। তবে ব্যবস্থাটিও যেহেতু সফটওয়্যার-চালিত, তাই সোর্স কোডসংক্রান্ত সমস্যাটি এখানে থেকেই যাচ্ছে। নির্বাচনের ঠিক আগে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রতিটি ইভিএম মাদারবোর্ড পরীক্ষা করা, পরীক্ষা শেষে প্রতিটি সফটওয়্যারের ডিজিটাল ছাপ (ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট) সংরক্ষণ করা দুরূহ কাজ। সব কটি যন্ত্রের (প্রায় ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্র এবং লক্ষাধিক ইভিএম) হার্ডওয়্যারের লিস্ট, সার্কিট ডিজাইন, হার্ডডিস্কের ফরেনসিক কপি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রধান প্রধান রাজনৈতিক পক্ষকে দেওয়া হচ্ছে না এবং তাদের সেসব যাচাইয়ের কারিগরি সক্ষমতাও নেই। (২৮ মে ২০২২, ডেইলি স্টার)।

নির্বাচন কমিশনের একটি অংশের সঙ্গে কোনো জালিয়াতপক্ষের সংযোগ থাকলে এসব জটিল কারিগরি ব্যবস্থা যাচাই-বাছাই অসম্ভব। প্রতিটি ইভিএম সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার একই ভার্সনে তৈরি করাও অসম্ভব। এতে বিশাল খরচের প্রশ্ন জড়িত। প্রযুক্তিবিদ সাইফুর রহমানের মতে, সিস্টেমকে সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম মনিটরিং সফটওয়্যার গুরুত্বপূর্ণ। ভোট চলাকালে কেন্দ্রের কেউ যদি ইভিএমের সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যার পরিবর্তন করেন বা অসদুদ্দেশ্যে কোনো প্রোগ্রামিং স্ক্রিপ্ট প্রবেশ করান, তাহলে তা সংকেত ও এসএমএস দিয়ে সব পক্ষকে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভোট বন্ধ করার ব্যবস্থা বাংলাদেশের ইভিএমে নেই।

শেষে আছে খরচের প্রশ্ন। বাংলাদেশের লক্ষাধিক ইভিএমের প্রতিটির মূল্য দুই লক্ষাধিক টাকা, বিপরীতে ভারতে একটি ইভিএমের দাম বর্তমানে মাত্র ১৭ হাজার রুপি। আছে ৬৪ জেলায় ইভিএম রাখার গোডাউনভাড়ার খরচ, কারিগরি পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ফি, এক্সপার্ট ও কনসালট্যান্সি ফি। এত খরচের পরেও কারচুপিহীন সুষ্ঠু নির্বাচন ইভিএমের ওপর নয়, বরং যাঁরা নির্বাচন পরিচালনা করবেন, সেই নির্বাচন কমিশনার ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এই ধারণা জোরালো যে, মূলত ক্ষমতাসীন দলই নির্বাচন পরিচালনা করে, আর নির্বাচন কমিশন তাদের আজ্ঞাবহ! তাই ইভিএমের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নির্বাচন কমিশন ও ভোট-ব্যবস্থার ওপর আস্থা থাকল কি না, সেটি।

  • ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সিনিয়র সফটওয়্যার সলিউশন আর্কিটেক্ট, ভোডাফোন জিগগো নেদারল্যান্ডস। টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ। faiz.taiyeb@gmail.com