সম্প্রতি সিইসি ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের এক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা ইভিএম নিয়ে অনেকগুলো নির্বাচন করলাম। জাতীয় সংসদ নির্বাচন করলাম, স্থানীয় সংসদ নির্বাচন করলাম, সেখানে আমরা সফলতা পেয়েছি।’ (প্রথম আলো, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯)। ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সফলতা? কোন সফলতার কথা সিইসি বলছেন?
জাতীয় নির্বাচনের কথায় আসা যাক। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী এই ছয় আসনে ভোট পড়ার হার ছিল ৫১ দশমিক ৪২ শতাংশ। পক্ষান্তরে অন্য ২৯৪টি আসনে, যেখানে ব্যালট পেপার ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে এ হার ছিল ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ ইভিএমের তুলনায় ব্যালট পেপার ব্যবহৃত আসনগুলোর ভোটের হার ছিল ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। তাই প্রশ্ন জাগে, কোনটি ভোট পড়ার সঠিক হার? ইভিএমের? না ব্যালট পেপারের? একই নির্বাচনে দুটি হার কোনোভাবেই সঠিক হতে পারে না।
সিইসির বক্তব্য অনুযায়ী, কমিশন ইভিএম নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সফল। অর্থাৎ ইভিএমের ভোট পড়ার হার সঠিক, যদিও এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে কোথাও কোথাও ভুলত্রুটির কথা স্বীকার করেছিলেন (প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯)। সিইসির সাম্প্রতিক বক্তব্য যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে ব্যালট পেপার ব্যবহৃত আসনগুলোর ভোটের হার নিঃসন্দেহে কারসাজির ফসল এবং বাতিলযোগ্য। সিইসির এ অবস্থান গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার অভিযোগের পক্ষেই অকাট্য প্রমাণ। প্রসঙ্গত, বিবিসি আগের রাতে ভর্তি করা ব্যালট বাক্সের ভিডিও প্রকাশ করে। আমাদের সিইসির অতীতের একটি বক্তব্যও—ইভিএম ব্যবহার করলে রাতের ভোটের সমস্যা এড়ানো যাবে (দ্য ডেইলি স্টার, ৯ মার্চ ২০১৯)—এমন অভিযোগের প্রতিই পরোক্ষ সমর্থন প্রদান করে।
আর যদি ব্যালট পেপারে ভোট পড়ার হার সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে ইভিএম ব্যবহারের কারণে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কোনো কোনো আসনে ভোটাররা আরও বেশি হারে ভোটদান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যেমন ইভিএম ব্যবহৃত ঢাকা-১৩ আসনে ভোট পড়ার হার ছিল মাত্র ৪৩ দশমিক ০৫ শতাংশ। ভোটারদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার এ দায়ভার নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে। এখানে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন: এ বঞ্চনা কি ইভিএমে ভোট প্রদানে জটিলতা, ভোটারদের অনীহা, না ইভিএমের ত্রুটি? যদি এর যেকোনো একটির কারণে তা হয়ে থাকে, তাহলে আসন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও একটি মস্ত বড় ভুল সিদ্ধান্ত।
উল্লেখ্য, ইভিএম ব্যবহৃত আসনগুলোয় ভোট প্রদানের হার নিয়ে নির্বাচন কমিশন নিজেই একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে। যেসব আসনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গৃহীত হয়েছে, সেখানে ভোটকেন্দ্র বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফলাফল পাওয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু ইভিএমের মাধ্যমে গৃহীত আসনগুলোর ভোটের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে অনেক পরে, যদিও ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছিল বিকেল চারটায়। বিলম্বে এ ফলাফল প্রকাশ জনমনে কমিশনের পক্ষ থেকে কারসাজির সন্দেহ দানা বাঁধাই স্বাভাবিক।
নির্বাচন কমিশনের ব্যবহার করা ইভিএমে ভোটারদের বায়োমেট্রিকস বা আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে ভোট দিতে হয়। যদি আঙুলের ছাপ মেশিন পড়তে না পারে, তাহলে নির্ধারিত নির্বাচনী কর্মকর্তা ২৫ শতাংশ ভোটারের বায়োমেট্রিকস ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা ‘ওভাররাইড’ বা বাদ দিতে পারেন (বিবিসি বাংলা, ২৪ নভেম্বর ২০১৮)। ভোটারের অনুপস্থিতিতে নির্বাচনী কর্মকর্তা যে এ ক্ষমতা অপব্যবহার করে, তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে দেবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বহু পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগ উঠেছে। এই সমস্যার সঙ্গেও নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা জড়িত। প্রসঙ্গত, ভোটারদের আশ্বস্ত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুজন সেনাসদস্য ইভিএমের দায়িত্বে থাকবেন।
ইভিএম নিয়ে আরেকটি সমস্যা হলো যে এটি আগে থেকেই এমনভাবে ক্যালিব্রাইট বা প্রস্তুত করা যেতে পারে, যাতে ভোটার যেকোনো প্রার্থীকে ভোট দিলেই তা কোনো পূর্বনির্ধারিত প্রার্থীর পক্ষে রেকর্ড হয়ে যাবে। বর্তমানের উন্নত প্রযুক্তির যুগে এটি করা একেবারেই অসম্ভব নয়। এ ছাড়া ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী প্রার্থীর প্রতিনিধি ভোটিং বুথে উপস্থিত থেকে ভোটারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারার অভিযোগ বিগত নির্বাচনে উঠেছে। আবারও বেড়ায় খেত খাওয়ার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ থাকলে, ভবিষ্যৎ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব হবে না।
নির্বাচন কমিশনের ব্যবহৃত ইভিএমের একটি বড় দুর্বলতা হলো যে এতে ‘পেপার অডিট ট্রেইল’ বা ইভিএমে প্রদত্ত ভোট কাগজে রেকর্ড হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা পরবর্তী সময়ে নিরীক্ষার কোনো সুযোগ থাকে না। ভেরিফায়েড ভোটিং ফাউন্ডেশনের মতে, প্রোগ্রামিংয়ে ভ্রান্তি, যান্ত্রিক ত্রুটি এবং বিদ্বেষাত্মক টেম্পারিং বা কারসাজি কম্পিউটারভিত্তিক ভোট প্রদানের যন্ত্রের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা। তাই এটি গুরুত্বপূর্ণ যে এ যন্ত্রে ভোটারের পক্ষে যাচাই করা যায় এমন নিরীক্ষণ পদ্ধতি থাকে, যাতে প্রতিটি ভোটের একটি স্থায়ী রেকর্ড সংরক্ষিত হয়, যা প্রত্যেক ভোটার ভোট প্রদানের আগে এর সঠিকতা যাচাই করতে পারেন এবং যা যাচাইয়ের পর পরিবর্তন করা দুরূহ বা অসম্ভব হবে। অনেকগুলো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে যা কেনা হয়, তাতে এ বৈশিষ্ট্য থাকে না...ভোটারের যাচাই করার মতো নিরীক্ষা পদ্ধতি থাকাটা নতুন ভোটিং মেশিন সার্টিফিকেশনের বা ব্যবহারের সম্মতি প্রদানের একটি অতিপ্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত হওয়া আবশ্যক। (https://www.verifiedvoting.org/ resources/vvpr-legislation/)
প্রসঙ্গত, এই দুর্বলতা দূর করার জন্য দিল্লি হাইকোর্টের একটি রায় অনুসরণে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ২০১১ সালে তাঁদের ব্যবহৃত ইভিএমে ‘ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল’ সংযুক্ত করার নির্দেশ দেন। সাত-আট বছর পরে নির্মিত এবং অনেক বেশি দামে কেনা ইভিএমে এ ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখার ব্যাপারে আমাদের নির্বাচন কমিশনের উদাসীনতা প্রদর্শন আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। এ উদাসীনতা কমিশনের ইভিএম ব্যবহার–সম্পর্কিত সিদ্ধান্তকে দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উল্লেখ্য, আমাদের ইভিএম প্রকল্পের কারিগরি ও পরামর্শক কমিটির সুপারিশ অমান্য করে ইভিএমে পেপার অডিট ট্রেইল সুবিধা না রাখার কারণে উক্ত কমিটির উপদেষ্টা প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী সাব কমিটির সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি।
কমিশনের সিদ্ধান্ত আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ইভিএমের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের অতি উৎসাহের কারণে। এ অতি উৎসাহ প্রতিফলিত হয়েছে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান হওয়ার আগেই কমিশনের পক্ষ থেকে ইভিএম কেনার কার্যাদেশ প্রদান করার মাধ্যমে। রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই ইভিএম ব্যবহারে কমিশনের উদ্যোগ এ অতি উৎসাহের আরেকটি প্রতিফলন, যদিও দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিইসি বলেছিলেন: সব দল না চাইলে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না (প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট ২০১৮)। ২০১৮ সালের ৭ জুন পটুয়াখালীতে দেওয়া এক বক্তব্যে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন সিইসি। তাই রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অতি উচ্চ দামে ইভিএম কেনার সঙ্গে কমিশনের কী স্বার্থ জড়িত, তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে।
উল্লেখ্য, পেপার ব্যালটের ব্যবহার ভোট জালিয়াতি রোধে একটি বড় রক্ষাকবচ। যেমন ব্যালট পেপারে ভোট প্রদান প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হওয়ায় এর ওপর ভোটারের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি। গণমাধ্যম ও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকেরাও তাঁদের নিরপেক্ষ ভূমিকার মাধ্যমে ভোট প্রদান ও গণনার প্রক্রিয়া সুষ্ঠু করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। প্রার্থীর এজেন্টের উপস্থিতিও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পক্ষান্তরে, ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বহুলাংশে নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর, যার অভাবে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ইতিমধ্যেই জনগণের ব্যাপক অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই খুলনা, গাজীপুর আর বরিশাল সিটির নির্বাচনের মতো ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে জালিয়াতির নির্বাচন দেখতে চাই না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক