ইভিএম প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ইসির, কোনো দল নয়

২০০৮ সালের শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ জোট সরকার গঠন করে। তারা উঠিয়ে দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এরপর প্রকৃত অর্থে দেশে কোনো গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন হয়নি। কার্যত, জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না এ দুটি নির্বাচনে। তবে এটা ঠিক, তারা সোচ্চারও হয়ে ওঠেনি দৃশ্যমানভাবে। এ অবস্থাতেই ২০২৩ সালের শেষাবধি আরেকটা নির্বাচন এগিয়ে আসছে। এটা সামনে রেখে সংসদের বাইরের দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্ররা ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, বর্তমান সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। এ ছাড়া বলছে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হতে পারবে না। পক্ষান্তরে, সরকারের পক্ষ থেকে জোরের সঙ্গেই বরাবর বলা হচ্ছে, তাদের সরকার ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচনে যাবে। ইভিএম ব্যবহারের অনুকূলেও রয়েছে তারা। এমন অবস্থায় আমরা একটি অচলাবস্থা লক্ষ করছি।

তবে অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন নজরে আসে পশ্চিমা বিশ্বের আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে অব্যাহত বিভিন্ন প্রয়াসে। তারা মানবাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় নিয়েও সোচ্চার। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র‍্যাব ও তার কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিষয়টি দুঃখজনক হলেও বাস্তব। ঠিক তেমনি সফল নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থতার জন্য আফ্রিকার একটি দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আরোপ করেছে অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা। জ্ঞাত-অজ্ঞাত কারণে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য বিশ্বের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি এড়িয়ে চলছিল। তবে মনে রাখতে হবে, রপ্তানি–বাণিজ্যের কার্যত সিংহভাগ অংশীদার পশ্চিমা বিশ্ব। তাই তাদের আস্থায় রাখার প্রয়োজনীয়তা আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। সর্বোপরি মানবাধিকার কিংবা অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্নে তাদের পরামর্শগুলো আমাদেরও জাতীয় দাবি। সঠিক নির্দেশনা দেওয়া কিংবা জাতিকে সংগঠিত করার মতো রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতির সুযোগে আমাদের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী সংস্কৃতি দৈন্যদশায় পড়েছে।

তবে কিছুটা আশার বাণী শুনলাম সরকারপ্রধানের কাছ থেকে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় তিনি নিজ দলকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। কোনো এমপিকে জিতিয়ে আনার দায়িত্ব নেবেন না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য, তিনি স্পষ্টতই বলেছেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সম্ভাব্য সব প্রচেষ্টা নেওয়া হবে। তবে আবার ইঙ্গিত দিয়েছেন, সব কটি নির্বাচনী এলাকায় ইভিএমে ভোট গ্রহণ হবে। তাঁর এ ঘোষণার পরপরই বিএনপি তাদের পূর্বোক্ত অবস্থানে অনড় বলে বিবৃতি দিয়েছে। তবে রাজনীতিতে সরকার কিংবা বিরোধী দল, কারও জন্য শেষ কথা বলে কিছু নেই। তাই প্রথমে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি কিছু আলোচনা করা যাক।

বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সম্ভাব্য সব প্রচেষ্টার কথা বলার জন্য সরকারপ্রধানকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আর এখনো যেহেতু বছর দেড়েক সময় আছে, চেষ্টা শুরু করতে হবে অচিরেই। তারা ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল। সে সুযোগ আওয়ামী লীগ নেয়। অশোভনভাবে দেশের অধিকাংশ আসনে নির্বাচন ছাড়াই এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন নামক কিছুটা দৌড়ঝাঁপ যেখানে হয়েছে, সেগুলোও লোকদেখানো এবং অনেকটাই হাস্যকর। খাঁ খাঁ করা ভোটকেন্দ্রে সন্ধ্যায় গণনায় হাজার হাজার ভোটের সংখ্যা দেখা গেল। এরূপ সত্ত্বেও অনেক টানাহেঁচড়ার পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি–দলীয় জোট অংশ নেয়।

সব কথার ওপরে বলতে হয়, আমরা গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। এটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। দুর্ভাগ্য আমাদের, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও সে অধিকার প্রয়োগের জন্য লড়তে হচ্ছে। অথচ দেশটির স্বাধীনতার প্রধান চেতনাই ছিল গণতন্ত্র। আর অংশগ্রহণমূলক ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার আইনি অধিকার। গণতন্ত্রের অর্গল মুক্ত করুন। মানুষ যাদের চায়, তারাই করুক দেশ শাসন।

তবে শুরুতে সরকারের পক্ষ থেকে ভিন্ন রকম বলা হলেও নির্বাচনী প্রক্রিয়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিন্দুমাত্র বৈশিষ্ট্য ছিল না। সভা–সমাবেশ, এমনকি ঘরোয়া সভাতেও হামলার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। হতে হয় মামলার আসামি। স্তব্ধ করে দেওয়া হয় তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া। সাংগঠনিকভাবে স্থবির হয়ে পড়ে তারা। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে প্রার্থী দেওয়া হয় বটে, তবে প্রায় প্রতিটি স্থানে নির্বাচনের কিছুদিন আগে বিরোধী দলের কর্মী–সমর্থকদের মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার বা আতঙ্কে এলাকাছাড়া করা হয়। নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রচার অভিযানে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করা হয় বিঘ্ন। বহুসংখ্যক প্রার্থী ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বের হতে পারেনি। এগুলো তো সেদিনের কথা। এটি পরিচিতি পায় মধ্যরাতের নির্বাচন নামে।

এখন যখন বিরোধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাব্য সব প্রচেষ্টা নেওয়ার কথা বলছে সরকার, তখন সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক কর্তৃত্বে বাস্তবায়ন করুন। বিরোধী দলগুলোকে আইন মেনে সভা–সমাবেশের অবারিত সুযোগ দিন। সুযোগ দিন সংগঠিত হতে। এর মধ্যে চলতে থাকুক আলোচনা। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে যে বিতর্ক, তা–ও সমাধান করা যায় কিছুটা এদিক–সেদিক করে। গতবার তারা তো বিনা শর্তেই এসেছিল। সেখানে ক্ষমতায় থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব—এটা প্রমাণ করতে সরকার সফল হয়নি। এমনকি ছিল না সচেষ্ট। এখানে একটি বড় দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত দুটি কমিশন তাদের দায়িত্ব পালনে জাতিকে হতাশ করেছে। এবারের কমিশন কী করবে, আমরা এখনো বুঝতে সক্ষম হইনি। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন বাস্তবতায় সরকার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়তো করাতে চাইবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন আগ্রাসী ভূমিকা নিলে সুড়ঙ্গের অপর দিক খুলে যেতে পারে।

আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সরকারপ্রধান আগামী নির্বাচনে সব ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহারের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, এতে আমরা কিছুটা বিস্মিত। কার্যত বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন। এখানে আওয়ামী লীগ একটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল। দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমান কমিশন এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা করেছে, এমনটা আমরা শুনিনি। তাহলে সিদ্ধান্তটি কে নিলেন? তারপরও যে বিষয়গুলোর ওপর বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ নির্ভরশীল, সেগুলোর একটি তো ইভিএম। ইভিএম যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ ও গণনার একটি পদ্ধতি। এটা ভারত সম্পূর্ণ গ্রহণ করলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই করেনি।

আমরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে প্রযুক্তির উত্তরোত্তর ব্যবহার বৃদ্ধি চাই। তবে সে প্রযুক্তি হতে হবে ব্যবহারকারীবান্ধব, নির্ভরযোগ্য ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ইভিএম নিয়ে দেশে–বিদেশে বিতর্ক আছে। ভারতেও ইভিএমের অংশ হিসেবেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইলও (ভিভিপিএটি) ব্যবহার করছে। আর আমাদের এটা তো শুধু রিড অনলি মেমোরি। এতে শুধু ভোট গ্রহণ ও গণনার সুবিধা আছে। তবে বিতর্ক হলে খতিয়ে দেখার জন্য কোনো রেকর্ড নেই। আমরা যতটুকু জানি, গত কমিশন বহুসংখ্যক ইভিএম কিনে গুদামজাত করে রেখেছে। মাঝেমধ্যে সীমিত আকারে ব্যবহার হয়। এগুলো ব্যবহার প্রয়োজন। তবে যেখানে এত সন্দেহ, এত অবিশ্বাস্য সেখানে অন্তত ভিভিপিএটি ছাড়া সারা দেশে একত্রে এ মেশিন ব্যবহারের কথা কীভাবে ভাবা যায়?

সব কথার ওপরে বলতে হয়, আমরা গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। এটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। দুর্ভাগ্য আমাদের, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও সে অধিকার প্রয়োগের জন্য লড়তে হচ্ছে। অথচ দেশটির স্বাধীনতার প্রধান চেতনাই ছিল গণতন্ত্র। আর অংশগ্রহণমূলক ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার আইনি অধিকার। গণতন্ত্রের অর্গল মুক্ত করুন। মানুষ যাদের চায়, তারাই করুক দেশ শাসন। এমনকি ক্ষমতায় যাঁরা আছেন, তাঁরাও জনগণের ম্যান্ডেট পেলে আরও অধিককাল দেশ শাসন করতে পারেন। তবে সরকারপ্রধানের সাম্প্রতিক ঘোষণা ও বিএনপির প্রতিক্রিয়ায় আমরা আশা–নিরাশার দোলাচলে রইলাম।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

majumderali1950@gmail.com