রমজানের অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত হলো ইফতার। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে তারা আমার বেশি প্রিয়, যারা দ্রুত ইফতার করে (তিরমিজি, আলফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৬০, পৃষ্ঠা: ১৩১)।’ নবীজি (সা.) বলেন, ‘যখন রাত সেদিক থেকে ঘনিয়ে আসে ও দিন এদিক থেকে চলে যায় এবং সূর্য ডুবে যায়, তখন রোজাদার ইফতার করবে (বুখারি, সাওম অধ্যায়, হাদিস: ১৮৩০)।’ ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সে পর্যন্ত দ্বীন ইসলাম বিজয়ী থাকবে, যে পর্যন্ত মানুষ শিগগির ইফতার করবে। কেননা, ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা বিলম্বে ইফতার করত (মুসনাদে আহমাদ)।’ হজরত সাহল ইবনে সাআদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যত দিন লোকেরা ওয়াক্ত হওয়ামাত্র ইফতার করবে, তত দিন তারা কল্যাণের ওপর থাকবে (বুখারি, সাওম অধ্যায়, হাদিস: ১৮৩৩)।’
মুমিনের জীবনের লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। আনুগত্যে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন, তাই মুমিনরা ইবাদতে আনন্দ লাভ করেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি খুশি—একটি ইফতারের সময়, অপরটি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় (মুসলিম)।’ আল্লাহ তাআলার নির্দেশ, ‘তোমরা সন্ধ্যা (সূর্যাস্ত) পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৭)।’
ইফতার অর্থ উপবাস ভঞ্জন করা। ভোর থেকে সারা দিন ‘সাওম’ পালন শেষে রোজাদার সূর্যাস্তের পর প্রথম যে পানাহারের মাধ্যমে উপবাস ভঞ্জন করেন, তাকে ‘ইফতার’ বলা হয়। যে খাদ্য বা পানীয় দিয়ে ইফতার করা হয়, তাকে ‘ইফতারি’ বলা হয়। ইফতারের আগেই ইফতারি সামনে নিয়ে অপেক্ষা করা এবং যথাসময়ে ইফতার করা সুন্নাত। ইফতারি সামনে নিয়ে দোয়া করলে সেই দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রোজাদারের দোয়া আল্লাহর কাছে এতই প্রিয় যে আল্লাহ তাআলা রমজানের সময় ফেরেশতাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘রমজানে তোমাদের পূর্বের দায়িত্ব মওকুফ করা হলো এবং নতুন দায়িত্বের আদেশ করা হলো, তা হলো আমার রোজাদার বান্দারা যখন কোনো দোয়া মোনাজাত করবে, তখন তোমরা আমিন! আমিন!! বলতে থাকবে (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)।’
সহমর্মিতা ও সমবেদনার মাস রমজান। তাই ব্যয়বহুল বাহারি ইফতারের আয়োজন না করে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, নিকটজন, গরিব–মিসকিন, অসহায়দের ইফতারের বিষয়ে যত্নবান ও সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
যেকোনো ফল দিয়ে ইফতার করলেও সুন্নাত আদায় হবে। মিষ্টান্ন দিয়ে ইফতার করলেও সুন্নাত পালন হবে। যদি তা–ও সম্ভবপর না হয়, তাহলে যেকোনো হালাল খাদ্যবস্তু, এমনকি শুধু পানি দিয়েও ইফতার করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ রোজা রাখলে খেজুর দিয়ে যেন ইফতার করে, খেজুর না হলে পানি দিয়ে; নিশ্চয় পানি পবিত্র (তিরমিজি ও আবু দাউদ, আলফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৬২, পৃষ্ঠা: ১৩১-১৩২)।’ পানিমিশ্রিত দুধ দিয়ে ইফতার করার কথাও বর্ণিত আছে। মাগরিবের নামাজের আগে ইফতার করা মুস্তাহাব বা উত্তম।
ইফতারের সময় দোয়া কবুল হয়। কোরআন–হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, এমন দোয়া উত্তম। এ ছাড়া নিজের ভাষায় নিজের মতো দোয়া করা যায়। ইফতারের আগে এ দোয়া পড়া সুন্নাত, ‘আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু’। অর্থ: হে আল্লাহ! আপনার জন্য আমি রোজা রেখেছি, আপনার রিজিক দিয়ে ইফতার করছি (আবু দাউদ, সাওম অধ্যায়)। বিভিন্ন কিতাবে আরও বিভিন্ন দোয়াও রয়েছে, সেসব দোয়াও পড়া যায়। ইফতারের আগে এ দোয়া পড়তে হয়, ‘ইয়া ওয়াছিআল ফাদলি, ইগফির লি।’ অর্থ: হে ক্ষমা প্রদানকারী! আমাকে মার্জনা করুন (ইবনে মাজাহ)।
সহমর্মিতা ও সমবেদনার মাস রমজান। তাই ব্যয়বহুল বাহারি ইফতারের আয়োজন না করে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, নিকটজন, গরিব–মিসকিন, অসহায়দের ইফতারের বিষয়ে যত্নবান ও সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ইফতার করা যেমন ফজিলতের, ইফতার করানোও তেমনি বরকতের। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে এবং রোজাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে। তবে ওই রোজাদারের সওয়াব কম করা হবে না।’
সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আমাদের অনেকেরই রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘পানিমিশ্রিত এক পেয়ালা দুধ বা একটি খেজুর অথবা এক ঢোঁক পানি দিয়েও যদি কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, তাতেও সেই পরিমাণ সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্তিসহকারে আহার করাবে, আল্লাহ তাআলা তাকে হাউজে কাউসার থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, যাতে সে জান্নাতে প্রবেশ করার আগপর্যন্ত তৃষ্ণার্ত হবে না (মুসনাদে আহমাদ)।’
সহমর্মিতা ও সমবেদনার মাস রমজান। তাই ব্যয়বহুল বাহারি ইফতারের আয়োজন না করে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, নিকটজন, গরিব–মিসকিন, অসহায়দের ইফতারের বিষয়ে যত্নবান ও সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়। পথশিশু, ছিন্নমূল ও পথিকদের ইফতারের ব্যবস্থা করাও কর্তব্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইফতার মাহফিল ও ইফতার পার্টির আয়োজন না করে গরিব–অসহায়দের দান–খয়রাত করা সমীচীন।
ইফতার ও সাহ্রিতে প্রয়োজন স্বাস্থ্যসম্মত হালাল খাবার। কারণ, হালাল খাদ্য ও হালাল উপার্জন রোজা, নামাজ ও যাবতীয় ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। তাই ইফতার ও সাহ্রিতে বৈধ উপার্জনের হালাল খাবার জরুরি।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম। smusmangonee@gmail.com