কয়েক দিন ধরে ব্যাংককের রাজপথে লাখো মানুষ বিক্ষোভ করছেন। তাঁরা জেনারেল প্রাউত চ্যান-ওচার সরকারের পদত্যাগ, বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং থাই রাজপরিবারের আইনি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের সংস্কার দাবি করেছেন। গ্রীষ্মের শুরুতে প্রধানত শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ থেকে এ বিক্ষোভ দানা বাঁধা শুরু করে। ছাত্রছাত্রীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের কঠোর সমালোচনা করা বক্তব্য, মেমে কিংবা ব্যঙ্গচিত্র পোস্ট করে বিক্ষোভকে চাঙা করে তুলেছে। সামরিক শাসনের মধ্যে বেড়ে ওঠা থাইল্যান্ডের নতুন প্রজন্মের ক্ষোভ প্রথমদিকে শুধু জেনারেল প্রাউতের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু এখন তার সঙ্গে আরও অনেক দাবি যোগ হয়েছে।
২০১৪ সালে এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রাউত গদিতে বসেন এবং ২০১৯ সালে একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে জয়লাভ করেন। থাইল্যান্ডের অর্থনৈতিক অবস্থা আগে থেকেই খারাপ ছিল। জেনারেল প্রাউত সে অবস্থা থেকে দেশকে বের করে আনতে তো পারেনইনি বরং কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশের অর্থনৈতিক সংকট বেড়েছে। এ কারণে প্রথম দিকে প্রাউতের পদত্যাগ বিক্ষোভকারীদের প্রধান চাওয়া ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাউতের সমালোচনা ও তাঁর পদত্যাগের দাবিকে সরকারের পক্ষ থেকে পাত্তা দেওয়া হয়নি। তবে গত আগস্টে বিক্ষোভরত জনতার সামনে পানুসায়া সিথিজিরাওয়াতানাকুল নামের ২১ বছর বয়সী এক তরুণ ১০ দফা দাবিসংবলিত একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করার পর বিক্ষোভ নতুন দিকে মোড় নেয়। পানুসায়ার ভাষণ বিক্ষোভে একটি ঐতিহাসিক মাত্রা যোগ করে এবং এরপরই বিক্ষোভ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
ঘোষণাপত্রটি পাঠ করার পূর্বমুহূর্তের অনুভূতি প্রসঙ্গে সম্প্রতি বিবিসিকে পানুসায়া বলেছিলেন, ‘এ ঘোষণা দেওয়ার পর কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা নিয়ে একটু ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, আমি এমন মুহূর্ত আর বাকি জীবনে পাব না।’ পানুসায়া যে দাবিগুলো তুলেছেন, তা থাইল্যান্ডের ইতিহাসে নজিরবিহীন। দাবিগুলোর অন্যতম হলো রাজাকে যে আইনের মাধ্যমে সব ধরনের অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে তা তুলে নিতে হবে, রাজার অসম্মান প্রতিরোধ করার আইন (যে আইনের মাধ্যমে রাজপরিবারের বিষয়ে যে কেউ সমালোচনা করলে তাকে জেল–জরিমানা করা হয়) বাতিল করতে হবে, রাজপরিবারের ব্যয় নির্বাহে সরকারি বরাদ্দ কমাতে হবে, রাজপরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক মন্তব্য করা থেকে বিরত রাখতে আইন করতে হবে, রাজপরিবারের সদস্যদের সমালোচনা করার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যত লোক গুমের শিকার হয়েছে, তাদের সবার অন্তর্ধানের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হতে হবে এবং অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গদি দখল করা কাউকে রাজপরিবারের সমর্থন দেওয়াকে বেআইনি ঘোষণা করতে হবে।
১৯৩০ সালে তরুণ একদল বেসামরিক আমলা সেনাবাহিনীর একটি অংশের সহায়তায় থাইল্যান্ডে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তির চেষ্টা করেছিলেন। তবে সে সময় তাঁরা তাতে সফল হননি। তারপর থেকে এ পর্যন্ত এভাবে থাই রাজপরিবারের প্রকাশ্য সমালোচনা দেখা যায়নি।
আজ সামরিক নেতৃত্ব রাজতন্ত্রকে ঘিরে রয়েছে এবং তারা রাজার ক্ষমতার সুরক্ষা সংরক্ষণকে তাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য হিসেবে দেখছে।
রাজতন্ত্রের যেকোনো সমালোচনার আইনি পরিণতি কী হতে পারে, তা চিন্তা করলে পানুসায়ার ভয় পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও তিনি এসব দাবি তুলেছেন এবং লাখো মানুষ তাতে সমর্থন দিয়েছে।
পানুসায়ার দাবির মধ্যে আরও যত দাবি আছে তা শুধু শিক্ষিত তরুণদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে না, শ্রমিকশ্রেণির দরিদ্র থেকে মধ্যবিত্ত—সবার অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। সব শ্রেণির মানুষ যখন এসব দাবিকে তাদের নিজেদের দাবি বলে মনে করেছে, তখনই রাজপথে লাখো মানুষ নেমে আসে। ১৪ অক্টোবর কয়েক লাখ লোক রাস্তায় নেমে এসে প্রাউতের সরকারি বাসভবন ঘেরাও করে তাঁর সরকারের পদত্যাগ দাবি করে।
জেনারেল প্রাউত বিক্ষোভকারীদের কোনো দাবি না মানার বিষয়ে অটল আছেন। পানুসায়ার ঘোষণাপত্র পাঠের পর তিনি জরুরি অবস্থা জারি করে সভা–সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন। পানুসায়াকে আটকও করেছেন। তবে তাতে শেষ পর্যন্ত কাজ হয়নি। জনগণের বিক্ষোভ থামেনি এবং বিক্ষোভের মুখে তিনি জরুরি অবস্থা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এখন ব্যাংকক ও অন্যান্য শহর উত্তাল হয়ে উঠেছে। এ বিক্ষোভ নতুন এক বিপ্লবের দিকে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আর সে ধরনের কোনো পরিবর্তন এলে থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে একটি বড় সংস্কার আসবে, তাতে সন্দেহ নেই।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ক্লাউডিয়া স্পোরানজেত্তি: সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক