ইতিহাস গড়ল যশোর শিক্ষা বোর্ড

নতুন ইতিহাস গড়ছে যশোর শিক্ষা বোর্ড। করোনাকালে তারা শুধু শিক্ষার দেখভাল বা ত্রাণ বিতরণ করেই দায়িত্ব শেষ করেনি। চলে গেছে কৃষকের খেতে। কাস্তে হাতে ধান কাটছে। এটা স্রেফ কোনো ফটোসেশন নয়। একটা যুগান্তকারী আন্দোলনও। যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোল্লা আমির হোসেনের নেতৃত্বে চলছে কৃষকের স্বেদ-রক্তে ফলানো সোনালি ফসল ঘরে তোলার এক মহা কর্মযজ্ঞ। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ ধান গত বছর অনেক কৃষকই সময়মতো কাটতে পারেননি। মজুর মেলেনি। উৎপাদন ব্যয় আর ফসল বেচা টাকায় লোকসানের ফারাক এত বেশি হয়ে যায় যে সোনার ফসল আগুনে পুড়িয়ে বাঁচতে চেয়েছেন কোনো কোনো কৃষক।

এবার দুনিয়াজুড়ে করোনার হানা। স্তব্ধ পৃথিবী। কারও রোজগার নেই। দুনিয়াজুড়ে অর্থনীতি অচল। তার মানে জীবিকা থমকে গেছে। জীবিকা থেমে গেলে জীবন থেমে যেতে বাধ্য। এক কঠিন দুর্ভিক্ষের আতঙ্ক গ্রাস করেছে দুনিয়ার সাড়ে সাত শ কোটি মানুষের মন। করোনার আগে আগে আফ্রিকা খেয়েদেয়ে আসছিল পঙ্গপাল। তখনই মানুষের মনের ঈষান কোণে মেঘ জমছিল। সে আতঙ্ক ছাপিয়ে হামলে পড়ল মানুষের লেখা ইতিহাসে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সেই দুর্যোগের দিনে একটা শিক্ষা বোর্ড প্রতিদিন হাজির হচ্ছে কোনো না কোনো এলাকায়। তাদের দেখে উৎসাহের, সম্মানের অন্ত নেই কৃষকের, এলাকার শিক্ষক–ছাত্র অভিভাবকদের। তাঁরাও নেমে পড়ছেন খেতে। কষ্টে ফলানো সোনার ফসল ঘরে তুলতে হবে সবার আগে। এবার আকাশও বৈরী। হররোজ বৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে হালকা ঝড়। তাই উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার সীমা নেই কৃষকের।
একেই বলে, ‘আপনি আচারি ধর্ম অপরে শেখাও।’ কেন যশোর শিক্ষা বোর্ড অচেনা কৃষকের ফসল তুলতে এই বৈশাখী তপ্ত হাওয়ায় ঘর ছেড়ে মাঠে গেলেন ছুটে? তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব তো এ কথা বলেনি। তারা হৃদয়ের গভীরে শুনতে পেয়েছেন বিবেকের নির্দেশ। সেই নির্দেশ তারা পালন করে চলেছেন এক গভীর ভালোবাসা থেকে, জাতীয় দায়িত্বের অতিপ্রয়োজনীয় অংশ হিসেবে। বিবেকের নির্দেশেই তারা এই সেবা ব্রতে আত্মনিয়োগ করছেন। কেউ তাদের বলেনি, বাধ্য করেনি। এ এক অতুলনীয় স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের দৃষ্টান্ত।
এর অর্থনৈতিক মূল্য যত, সামাজিক মূল্য তার চেয়ে সহস্র গুণ বেশি। কিছু কথা আগেই বলেছি। পুনরুক্তি বাহুল্য। যশোর শিক্ষা বোর্ড এই বার্তা নিয়ে গেছে যে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষকই জাতির মেরুদণ্ড। সভ্যতা যতই এগিয়ে যাক, জমিনে ফলানো ফসলই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। মানুষই দুনিয়ায় একমাত্র প্রাণী যে উৎপাদন করতে পারে, রূপান্তর ঘটাতে পারে। কিন্তু অন্য প্রাণী প্রাকৃতিক উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে।
আর কী বার্তা? সেটা হলো শ্রমের মর্যাদা। কোনো কাজই ছোট নয়। আরও বলা, শিক্ষা বোর্ড শুধু পরীক্ষা নেওয়া, রেজাল্ট দেওয়া, প্রতিষ্ঠান তদারকিই করে তা নয়; দরকার হলে আর্তমানবতার সেবায় নিজেরা জান বাজি রেখে সামিল হতে জানে। ছাত্রের লেখাপড়ার খরচ আসে তার অভিভাবকের শ্রম থেকে উপার্জিত অর্থে। কাজেই বিপদে সেই অভিভাবকের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোই প্রথম কর্তব্য।
আগেই বলেছি, এ শুধু কিছু জমির ধান কাটা নয়, এ হলো রাষ্ট্রকে এই বার্তা দেওয়া যে এক মুঠো ধানও শেষ বিচারে কোনো ব্যক্তি কৃষকের নয়। তা হলো গোটা রাষ্ট্রের। প্রতি দানা ফসলই জাতির সম্পদ, জাতীয় সম্পদ। তাই যশোর শিক্ষা বোর্ড কোনো বিশেষ কৃষকের নয়, তারা অভিযানে নেমেছে জাতীয় সম্পদ রক্ষার লড়াইয়ে।
আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি হচ্ছে যে যশোর শিক্ষা বোর্ড যেভাবে সাড়া দিয়েছে, তা আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি খুবই উদ্দীপ্ত হয়েছি, গর্ব বোধ করছি। গোটা খুলনা বিভাগের মানুষ সংকট মোকাবিলায় তাদের কথা মনে রাখবে বহু কাল। তারা এক নতুন মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করল। তাদের আহ্বানে এই জনপদের মানুষ একে অপরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে লড়াই করার মন্ত্র শিখেছে। এ শিক্ষা ছড়িয়ে যাক সবখানে। প্রতিবছর এমনি করে আমরা সবাই যদি কৃষকের পাশে গিয়ে হাজির হই, তাহলে তাদের বল বাড়বে, শক্তি বাড়বে। কৃষক আত্মপ্রত্যয়ী হলে জাতি বাঁচবে, দেশ বাঁচবে।
একাত্তরে এই কৃষকই আমাদের কোটি কোটি আশ্রয়হারা মানুষকে, বিপদ সুনিশ্চিত জেনেও মুক্তিসেনাদের নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্য জুগিয়ে বিজয় সুনিশ্চিত করেছিল। যুদ্ধের ময়দানে যে অকুতোভয় মুক্তিসেনারা জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলেন, তাঁদেরও ৯০ ভাগ ছিলেন গ্রামের কৃষকের সন্তান। যশোর শিক্ষা বোর্ড সে ঋণের এক অতি সামান্য ভগ্নাংশ হলে শোধ করার নজির রাখল।
সারা দুনিয়ায় কর্মী ছাঁটাই চলছে। আশঙ্কা জাগছে আমাদের প্রবাসী ভাইদের বিদেশে কর্মসংস্থান নিয়ে। যে মহামন্দার ভয়ে কাঁপছে সারা দুনিয়া, তা থেকে মুক্তির আশু উপায় হবে আমাদের ফসলের সুরক্ষা। বিশ্বায়নের পরিচিত স্বভাব বদলে যাবে। নিজের পায়ে ভর করেই আমাদের টিকে থাকার লড়াই চালাতে হবে। সে লড়াইয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ড আদর্শ হয়ে রইবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে ইউরোপ ফিনিক্স পাখির মতো নতুন জন্ম লাভ করেছিল এই মন্ত্রে ‘প্রোডিউস অর পেরিস’ করো অথবা মরো। করোনা–উত্তর বাংলাদেশেও আমাদের সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে, ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।’
আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান