কলকাতার চিঠি

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সিঁড়িতে দার্জিলিং

এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। দার্জিলিং দাঁড়িয়ে আছে সেই ইতিহাসের সিঁড়িতে। আশির দশকে এই দার্জিলিংকে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে জিএনএলএফ নেতা সুভাষ ঘিসিং অশান্ত করেছিলেন, উত্তাল করেছিলেন দার্জিলিং। ১৯৮০ থেকে এখন দার্জিলিং ২০১৭-তে পা দিয়েছে। কিন্তু শান্তি আর ফিরে আসেনি। এখনো চলছে সেই একই ধারায় পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন। এখন জিএনএলএফ নেই। আছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। আর আছে জনমুক্তি মোর্চার বিদ্রোহী অংশ। বিনয় তামাং গোষ্ঠী। তাই তো রাজনীতিকেরা মনে করছেন, দার্জিলিংয়ে ফের জিএনএলএফ নেতা সুভাষ ঘিসিংয়ের মতো পরিণতি হতে চলেছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুংয়েরও।

সত্যি কথা কি, পশ্চিমবঙ্গের কোনো রাজনৈতিক দলই চায় না দার্জিলিং বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র থেকে। পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি জেলা এই দার্জিলিং। পর্যটনশিল্প আর চা-শিল্পের ওপর নির্ভরশীল এই ছোট্ট জেলাটি। এখানের বেশির ভাগ মানুষ নেপালিভাষী। ১৯৮০ সাল থেকে সেই একই ইতিহাস যেন বারবার উঠে আসছে রাজনীতিতে। ২০০৭ সালের ইতিহাসই ফের উঠে এল দার্জিলিংয়ের মানচিত্রে এবার ২০১৭ সালে। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুং সেদিন যেভাবে জিএনএলএফের কাউন্সিলর হয়ে দলীয় প্রধান সুভাষ ঘিসিংয়ের সঙ্গে বিরোধে দল ছেড়ে গড়েছিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, সেভাবেই এবার জনমুক্তি মোর্চার কাউন্সিলর মদন তামাং দলীয় প্রধান বিমল গুরুংয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দার্জিলিংকে আবার নিজের হাতে পুরে নিয়েছেন।

বামফ্রন্টের আমলে যখন বিমল গুরুংরা দার্জিলিংকে অশান্ত করে তুলেছিলেন, তখন মমতা এসে দাঁড়িয়েছিলেন এই বিমল গুরুংদের পাশে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও বিমল গুরুংরা মমতার পাশে ছিলেন। এবার বিমল গুরুংয়ের প্রধান ছায়াসঙ্গী, জিটিএর কাউন্সিলর মদন তামাং হাঁটলেন বিমল গুরুংয়ের পথেই। রাজ্য সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে সরে এসে হাত মেলালেন রাজ্য সরকারের সঙ্গে। মমতাও পুরস্কার দিলেন বিনয় তামাংকে। জিটিএর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করলেন এই বিনয় তামাংকে। আর পাহাড় থেকে বিমল গুরুংকে তাড়িয়ে দেওয়া বা গ্রেপ্তার করার জন্য তৎপর হয়েছেন মমতা। যেমনটা সুভাষ ঘিসিংকে পাহাড় থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিমল গুরুং। আর এবার রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় বিমল গুরুংকেও তাড়ানোর জন্য মাঠে নেমেছে রাজ্য সরকার। সঙ্গে রয়েছেন বিনয় তামাং। যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

তাই তো ৭ অক্টোবর দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে জনমুক্তি মোর্চার বিভিন্ন অফিস দখল করে বিনয় তামাংরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিমল গুরুং নয়, এখন বিনয় তামাংই দার্জিলিংয়ের নেতা, শেষ কথা। বিমল গুরুং এখন পুরোনো ইতিহাস। তাই তো ওই দিনই বিনয় তামাংরা অফিস থেকে সরিয়ে দিয়েছেন বিমল গুরুংয়ের ছবি। উড়িয়েছেন দলের নতুন পতাকাও।

ইতিহাসের পেছনে তাকালে দেখা যাবে, সেই ১৯৮০ সালে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি নিয়ে দার্জিলিংয়ে প্রথম আন্দোলন শুরু করেন জিএনএলএফ বা গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা সুভাষ ঘিসিং। পরে ১৯৮৮ সালের ২২ আগস্ট সেদিনের বামফ্রন্ট সরকার, জিএনএলএফ ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যস্থতায় গড়া হয় পৃথক স্বশাসিত সংস্থা ‘দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ’। এর চেয়ারম্যান করা হয় সুভাষ ঘিসিংকে। পরবর্তী সময়ে এই পরিষদের নির্বাচনে সুভাষ ঘিসিং চেয়ারম্যান হন। অন্যদের মধ্যে কাউন্সিলর হন বিমল গুরুংও। একসময় সুভাষ ঘিসিংয়ের সঙ্গে বিমল গুরুংয়ের মতবিরোধ দেখা দিলে বিদ্রোহ করেন বিমল গুরুং। তারপরই ২০০৭ সালের ৭ অক্টোবর বিমল গুরুং গড়েন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। এরপর জনমুক্তি মোর্চা পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন করে অশান্ত করে তোলে দার্জিলিং। আর দার্জিলিং থেকে প্রকারান্তরে তাড়িয়ে দেওয়া হয় সুভাষ ঘিসিংকে। তিনি গিয়ে আশ্রয় নেন জলপাইগুড়িতে। এরপর আর তিনি ঠাঁই পাননি দার্জিলিংয়ে। মারাও যান দার্জিলিংয়ের বাইরে জলপাইগুড়িতেই।

সেদিন সুভাষ ঘিসিংয়ের বিদায়ের পর বিমল গুরুংয়ের আন্দোলন থামাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এগিয়ে আসেন। কথা দেন দার্জিলিংয়ে ফিরিয়ে আনবেন শান্তি। এরপরই মমতার উদ্যোগেই ২০১১ সালের ১৮ জুলাই সেই ১৯৮৮ সালের ধাঁচে গড়া হয় জিটিএ বা গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এই জিটিএর চেয়ারম্যান হন বিমল গুরুং আর কাউন্সিলর হন বিনয় তামাং। এবার ইতিহাসের পথ ধরে সেই ধারাবাহিকতায় জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিনয় তামাং বিদ্রোহ করে বসেন বিমল গুরুংয়েরই বিরুদ্ধে। ছাড়েন বিমল গুরুংয়ের সংস্রব। বিমল গুরুংয়ের অফিস দখল করে নামিয়ে দেন তাঁর ছবি। ওড়ান দলের নতুন পতাকা। আর এই কাজে বিনয় তামাংয়ের পাশে এসে দাঁড়ান মমতা। তাঁকে জিটিএর চেয়ারম্যান করেন। মুছে যেতে শুরু করে বিমল গুরুংয়ের নাম।

এই পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে ১০৭ দিন একটানা বন্‌ধের পর গত ২৭ সেপ্টেম্বর বন্‌ধ্‌ প্রত্যাহার করে নেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুং। এর আগে প্রত্যাহার করেন বিনয় তামাং। গত ১২ জুন থেকে শুরু হয় এই অনির্দিষ্টকালের বন্‌ধ্। যদিও জনমুক্তি মোর্চার বিদ্রোহী নেতা বিনয় তামাং বন্‌ধ্ প্রত্যাহারের লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বন্‌ধ্ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন আগে। মমতাও বিমল গুরুংকে প্রত্যাখ্যান করে সহযোগিতা করেন বিনয় তামাংকে। এখন বিনয় তামাং পাহাড়ের কর্তৃত্বে। যেমন ছিলেন সুভাষ ঘিসিং, বিমল গুরুংরা। যদিও আত্মগোপন করে থাকা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুং এখনো সক্রিয়। পাঠাচ্ছেন গোপন ডেরা থেকে বার্তা। ‘বিশ্বাসঘাতক’ বিনয় তামাংয়ের বিরুদ্ধে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বার্তা দিচ্ছেন। কিন্তু পারবেন কি বিমল গুরুং? কারণ, বিমল গুরুংয়ের বিরুদ্ধে পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি, খুন, যানবাহনে ভাঙচুর, আগুন, অফিস-আদালতে অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি অভিযোগে রাজ্য সরকার একাধিক মামলা করে বিমল গুরুংসহ তাঁর দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে। তবু বিমল গুরুং আশাবাদী, একদিন দার্জিলিংয়ের মানুষ গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াবেন। কিন্তু সত্যি কি পারবেন বিমল গুরুং? নাকি সুভাষ ঘিসিংয়ের মতো পরিণতি হবে বিমল গুরুংয়ের?

অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।