মতামত

ই–কমার্স এখন তাহলে কোন আইনে চলছে?

১৯৯২-৯৩ সাল বা তারও আগে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির প্রসার দেশে শুরু হয়। ১৯৯৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু বলল, চিন্তা নেই, আমাদের অভাব থাকবে না। দ্রুত বড়লোক বনে যাব।

সত্যি বলতে, আমার বাবার জমিজমা ছিল, কিন্তু আর্থিক সচ্ছলতা বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না। ফলে, সচ্ছল হওয়ার মানসিকতায় নতুন মাত্রা আসে। তাই ‘দ্রুত’ ধনী হওয়ার দিবাস্বপ্নে দুজনেই বিভোর। এরই ধারাবাহিকতায় দুজনে গুলশানের একটা হোটেলে এমএলএম কোম্পানির মিটিংয়ে যাই কয়েকবার। বড়লোক হওয়ার ‘তালিম সিদ্ধহস্ত’ হলে বাবাকে (যিনি এখন প্রয়াত) প্রয়োজনীয় টাকার জন্য বলি। তিনি প্রথমে কারণ জিজ্ঞাসা করলে কিছু না বলে দু-তিন দিন পরপর তাগাদা দিতে থাকি।

একদিন সন্ধ্যায় তিনি আমাকে নিয়ে বসলেন আর আদরের সুরে টাকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। আরও বললেন, আমি ওনাকে বোঝাতে পারলে চাহিদার অতিরিক্ত দেবেন। আবেগে আপ্লুত হয়ে সব খুলে বললাম। বাবা ছিলেন রাগী, বকা খাওয়ার শঙ্কাও ছিল। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি সেদিন কিছুই বললেন না। শুধু কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বাবা রে, দ্রুতলয়ে এবং বিনাশ্রমে অর্জিত কোনো কিছু স্থায়ী হয় না। ভেবে দেখো, যদি এত সহজেই বড়লোক হওয়া যায়, তবে তোমার আশপাশের সবাই কেন যোগ দিচ্ছে না? তা ছাড়া তুমি কি জানো, কেন ওই কোম্পানির লোকজন তোমাদের টার্গেট করছে, কেন তারা অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে চাইছে? কারণ, বিত্ত ও পরাক্রমশালীরা সব সময় দুর্বলদের টার্গেট করে। ওরা জানে দুর্বলরা নিরুপায়। মনে রেখো, আগাছা দ্রুত জন্মায়। পানি না পেলে দ্রুত মরেও যায়।’

বাবা টাকা দিতে চাইলেন, তবে অনুরোধ করলেন তাঁর কথাগুলো পুনর্বিবেচনার। বন্ধুর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পর বড়লোক হওয়ার পরিকল্পনা চিরতরে ভেস্তে গেল।

১৯৭৯ সালে ইংলিশ উদ্যোক্তা মাইকেল অলড্রিচ অনলাইনে ই-কমার্স ধারণা দিলেও ইন্টারনেটের গতি মন্থর হওয়ায় জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯৯১ সালে ইন্টারনেট সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হলে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান আমাজন মূলত ই-কমার্স ব্যবসাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে। বর্তমানে এর ব্যাপকতা এতটাই যে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বহু মানুষের জীবিকার উৎস ই-কমার্স। যা–ই হোক, দেশের অত্যধিক জনসংখ্যা, বিশেষ করে অল্প শিক্ষিত ও গরিবদের ভাগ্যোন্নয়নের আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়েছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। কালের বিবর্তনে গণমাধ্যমে আসছে এদের ছলচাতুরীর কথা। কিন্তু যার দ্বারা ই-কমার্সের এত প্রসার অর্থাৎ আমাজনের ব্যাপারে কয়টা প্রতারণার খবর পত্রিকায় পাই? নিন্দনীয় কিছু তো নেই-ই, উপরন্তু প্রতিষ্ঠানটি লভ্যাংশের কিয়দংশ বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও মানবকল্যাণে বিনিয়োগ করে।

অস্ট্রেলিয়ায় বেশির ভাগ মানুষ মূলত অনলাইনে কেনাকাটা করে, কখনো শুনিনি অমুক প্রতিষ্ঠান আপনার ফোনের অর্ডারে সাবান পুরে দিয়েছে। আবার যেকোনো দেশে ব্যবসা করতে চাইলে সেখানকার নিয়মনীতি অবশ্যই পালনীয়। যেমন, উবার অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসা শুরু করতে চাইলে দেশটির ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকার প্রথমে নিয়মনীতি বানায়। অর্থাৎ বিষয়টার একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে তাদের ব্যবসার অনুমতি দেয়। বলা বাহুল্য, ই-কমার্সসংক্রান্ত দু-একটা বাজে ঘটনা ঘটলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তৎপরতা চোখে পড়ার মতো।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অনৈতিকতার কথা গণমাধ্যমে বারবার চাউর না হলে কেউ মাথা ঘামায় না। আর তদারককারী সংস্থাগুলোর ব্যবহার একপ্রকার ধরি মাছ না ছুঁই পানি। যেমন ইভ্যালি, কয়েক দিন আগেও অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি সিরিজে ছিল অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। ধর্মের নামে প্রতারণা করে এহসান গ্রুপ ১৭ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে বলে প্রকাশ। ই-অরেঞ্জের ধাপ্পাবাজি ধরা পড়ে প্রতিষ্ঠানটির একজন ভারতে ধরা পড়লে। মজার ব্যাপার হলো প্রতিষ্ঠানগুলোর লেনদেন হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গেটওয়ে দিয়ে। মানে বাংলাদেশ ব্যাংক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়-ব্যয় সম্পর্কে অবহিত। এত দিন প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে টুঁ শব্দ শোনা না গেলেও এখন অনেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে লিখছেন। কেউ বিনিয়োগকারীদের লোভী বলছেন, কেউবা ‘অতীত পর্যালোচনার’ ভিত্তিতে বহুবিধ উপদেশ বাতলাচ্ছেন। সম্ভবত অবস্থা বেগতিক দেখে ২২ সেপ্টেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী ই-কমার্স নিয়ে নতুন আইন ও একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার ইঙ্গিত দেন। প্রশ্নটা এখানেই, এত আইন থাকার পরও নতুন আইন। তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো কোন আইনে চলছে?

আমাদের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো জানেনই না, ডিম আগে, না মুরগি আগে? অর্থাৎ নিয়মনীতি বা কোন আইন নতুন ব্যবসায় প্রযোজ্য হবে, তার সুরাহা না করেই দেদার বাড়ছে প্রতিষ্ঠান, চলছে বাণিজ্য। বহির্বিশ্বের তুলনায় এখানেই আমরা ব্যতিক্রম। যেকোনো কিছুতে প্রাতিষ্ঠানিক হীনতার সংস্কৃতি প্রচলিত দিনের পর দিন, কিছু ঘটলেই কেবল হইহুল্লোড়। আর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক রং যদি ক্ষমতাসীন দলের সমার্থক হয়, তাহলে পোয়াবারো। ভাবুন তো ই-কমার্স ইস্যুটা পরাক্রমশালীদের হলে আজ কি দেশে টর্নেডো বয়ে যেত না? যেহেতু বিষয়টা তথাকথিত ‘গরিব ও লোভীদের’, নতুন ইস্যুর আবির্ভাবে স্বাস্থ্যের হোতাদের মতো এটাও হারিয়ে যাবে খবরের অতলগহ্বরে। গ্রাহকদের কেউ হয়তো আত্মহত্যা করবে ঋণ শোধাতে না পেরে, কেউ ভিটেবাড়ি বিক্রি করে হবে সর্বস্বান্ত। অথচ যাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কথা, কোনো কিছুই তাঁদের স্পর্শ করবে না।

সমাজতত্ত্বে মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তির তিনটি বৈশিষ্ট্যের একটি লোভ, যার রাশ টানা যে কারও জন্যই চ্যালেঞ্জের। আর চারপাশের খয়ের খাঁরা যখন প্রাতিষ্ঠানিকতা ও নিয়মনীতির অভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যায়, তখন লোভ সংবরণ অবশ্যই কঠিন। বিশ্বব্যাপী প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের সঙ্গে পারিবারিক অনুশাসনগুলো এখন ভেঙে পড়ছে, সবাই ছুটছে ক্ষমতা ও বৈভবের দিকে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ ও ২০১১ সালে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে বন্ধুদের কেউ ধনী বা কেউ সর্বস্বান্ত হয়েছে। কখনো বিনিয়োগ করিনি, তবে হ্যাঁ, লোভ হাতছানি দিয়েছে বহুবার। প্রতিবারই বাবার উল্লিখিত কথাগুলোর সঙ্গে শিক্ষালব্ধ জ্ঞানের সংমিশ্রণে লোভের রাশ টেনেছি।

বর্তমান সময়ে মানসিক দৃঢ়তা ও পারিবারিক শিক্ষাই পারে আপনাকে অসৎ ব্যবসায়ীদের চটকদার বিজ্ঞাপন থেকে দূরে রাখতে। আপনার অধিক লোভ আর অসৎ ব্যবসায়ী—দুইয়ের সমন্বয়ে কিন্তু আপনি সর্বস্বান্ত। যাক, আপনি জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ নির্মোহ হতে চাইলে জার্মান সমাজ মনস্তত্ত্ববিদ এরিক ফ্রমের উক্তি—‘লোভ তলাবিহীন খন্দ, তৃপ্ত হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা ব্যক্তিকে শুধুই নিঃশেষ করে, কিন্তু কখনোই পরিতৃপ্তি দেয় না’—নিজেসহ পরিবারের সবার জন্য এটা রপ্ত করতে পারেন।

আশরাফ দেওয়ান অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেসের গবেষক।