নিজ মহাদেশে ইউরোপের মানুষ বহুদিন এমন যুদ্ধ দেখেনি। এখন প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা আর টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে আসছে যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ, হতাহত মানুষ কিংবা লাখ লাখ শরণার্থীর প্রাণ বাঁচানোর আকুতির ছবি। এর মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট দেখা দিয়েছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপজুড়ে একটা চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এই যুদ্ধ নিয়ে এখানে তিনটি বিষয় আলোচ্য। প্রথমত, গত শতাব্দী থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি হলো স্বচ্ছ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জনগণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মুক্তি, যুদ্ধ না বাধানো ও পারস্পরিক আর্থসামাজিক সম্পর্কের বিকাশ।
দ্বিতীয়ত, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম হলেও বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলো ছাড়া সর্বত্র বা খোদ রাশিয়াতেই স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানবাধিকার, সংবাদপত্রের বা ব্যক্তিস্বাধীনতার চর্চা গড়ে ওঠেনি। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনে রাশিয়া যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তার মধ্যে ক্রেমলিনের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন রয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা দেশটির জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নয়। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার সাত হাজারের বেশি বিজ্ঞানী, গবেষক, শিল্পী, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ, সুশীল সমাজ ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেনের ওপর আক্রমণের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছেন।
তৃতীয়ত, নিজেরা যুদ্ধে নামবে না জেনেও, আটলান্টিকের অপর পাড় থেকে মার্কিনরা ন্যাটো জোট সম্প্রসারণের নামে ইউরোপের পরিবেশ অস্থিতিশীল করে তুলছে। ইউরোপে ন্যাটো জোটের শক্তিশালী শরিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মার্কিনরা একরকম জোর করেই তাদের সামরিকায়ন নীতি বজায় রেখেছে। বিশ্বের নানা প্রান্তরে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়ে আরও অস্ত্র রপ্তানি বাণিজ্য মার্কিনদের পুরোনো কৌশল। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই কাজই মার্কিনরা আবার করছে।
এই মুহূর্তে ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপজুড়ে একটা ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। ন্যাটো জোট, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা রাশিয়া ও তাকে সমর্থনকারীরা এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী কেউ শেষ পর্যন্ত এই মানবিক বিপর্যয় রোধ করতে পারেনি। এই সময়ের মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ-আতঙ্কে প্রাণ বাঁচাতে মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ৮০ বছর পর ইউরোপীয় দেশগুলোর ‘যুদ্ধ নয় শান্তি ও সংহতি’র হিসাব আচমকাই পাল্টে গেছে। নিজ মহাদেশে শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় থাকলেও এ দেশগুলো দূর দেশে অস্ত্রের জোগান দিয়েছে বা পরোক্ষভাবে যুদ্ধপ্রিয় দেশ মার্কিনদের সঙ্গে যুদ্ধে শরিক হয়েছে। তবে মার্কিন-নির্ভরতা কমাতে এবং ন্যাটো জোটের বিস্তার ঠেকাতে জার্মানি ও ফ্রান্স বেশ কিছুদিন থেকেই চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ভালো ঠেকছিল না। এর মধ্যে ইউক্রেনের যুদ্ধ ইউরোপীয় নেতাদের ভবিষ্যতের হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। এতে করে ইউরোপীয় দেশগুলোর মার্কিন-নির্ভরশীলতা আবারও বেড়ে গেল। ১৮ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার হামলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা প্রসারিত করতে ৫০০ মিলিয়ন ইউরো অর্থ সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে।
এই মুহূর্তে ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপজুড়ে একটা ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। ন্যাটো জোট, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা রাশিয়া ও তাকে সমর্থনকারীরা এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী কেউ শেষ পর্যন্ত এই মানবিক বিপর্যয় রোধ করতে পারেনি। এই সময়ের মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ-আতঙ্কে প্রাণ বাঁচাতে মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ে।
যুদ্ধ-আক্রান্ত ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে সাতটি দেশের। সব থেকে বড় সীমান্ত রাশিয়ার সঙ্গে। এ ছাড়া রয়েছে বেলারুশ, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ার, স্লোভেনিয়া ও মলদোভার সীমান্ত। ৪ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইউক্রেনে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া আক্রমণ শুরু করলে, এই যাবৎ কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। এই শরণার্থীদের ঢলে এবার কেবলই নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা। কারণ, যুদ্ধকালীন জরুরি আইনে ইউক্রেন সরকার ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, রাশিয়ার আগ্রাসনের যুদ্ধ এড়াতে আগামী সপ্তাহ ও মাসগুলোতে ইউক্রেন থেকে ৪০ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে। প্রতিবেশী ও ইইউ দেশগুলো ইউক্রেনের নাগরিকদের ভিসা ছাড়াই প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে। রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ। হাঙ্গেরিতে ২ লাখ, স্লোভাকিয়ায় প্রায় ১ লাখ ৫৩ হাজার এবং আরও কয়েক লাখ মানুষ রোমানিয়া ও মলদোভাতে আশ্রয় নিয়েছে। এসব দেশ থেকে পরবর্তী সময়ে এই সব ইউক্রেনীয় শরণার্থী জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে বা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে আশ্রয় নিচ্ছে। এই মুহূর্তে প্রায় প্রতিদিন জার্মানিতে প্রায় ১০ হাজার শরণার্থী প্রবেশ করছে।
ইইউ দেশগুলো ৪ মার্চ ইউক্রেনের শরণার্থীদের গ্রহণ করার বিষয়ে দ্রুত নতুন সিদ্ধান্ত জারি করেছে। সিদ্ধান্তে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শরণার্থীরা ইইউ সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে প্রবেশ করতে পারবে। আগত এই শরণার্থীরা আপাতত এক বছর থাকার নিশ্চয়তাসহ বাসস্থান, ভাতা, চিকিৎসা, চাকরি ও শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে। ভৌগোলিকভাবে ইউক্রেন ইইউ দেশগুলোর কাছে হওয়াই, সেখান থেকে আসা শরণার্থীদের গ্রহণ করার সিদ্ধান্তটি অবশ্যই মানবিক। অবশ্য বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা শরণার্থীদের বিষয়ে ইইউ দেশগুলো এমন মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে অনৈক্য ও অনীহা দেখা যায়, তা লজ্জাজনক।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ইউরোপের মাটিতে ন্যাটো সামরিক জোট বিস্তারের হোতা দেশ যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের গ্রহণ করার বিষয়ে কোনো কথা বলছে না। অনেকেই মার্কিন ও ন্যাটো জোটের আগ্রাসী আধিপত্য বিস্তারের অযৌক্তিক যুক্তিকে এই যুদ্ধের জন্য দায়ী করছেন বা রাশিয়া একরকম বাধ্য হয়েই যুদ্ধে নেমেছে বলে বলছেন। অপর পক্ষ বলছে, কোনো সার্বভৌম দেশ কোনো জোটে যোগ দেবে বা না দেবে, তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার আগ্রাসী হয়ে ইউক্রেনে ওপর হামলার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নেই।
এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পেছনে যে কৌশলই থাকুক না কেন, যুদ্ধপীড়িত মানুষের কথা ভাবলে ইউক্রেনের যুদ্ধ বা বিশ্বের অন্য যুদ্ধগুলোর ক্ষেত্রে কোনো পক্ষ বা যুদ্ধকে বৈধতা দেওয়ার অর্থ মানুষের গভীর মানবিক দিকটাকে অবহেলা করা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইউরোপের নানা শহরে লাখ মানুষ যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। এই যুদ্ধ আবার আতঙ্কিত করেছে ইউরোপীয় জনপদের মানুষদের।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
Sharaf.ahmed@gmx.net