ইউরোপীয় কমিশনের ডিজিটাল নীতিতে প্রাধান্যে মানুষ

বিশ্বে ইউরোপীয় ইউনিয়নই প্রথম যারা ডিজিটাল অধিকারের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে
ছবি : রয়টার্স

ব্যবসা, পড়াশোনা, কেনাকাটা, সংস্পর্শে থাকা, সঙ্গী খোঁজা অথবা পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে ভালো সময় কাটানো, যেটাই ধরি না কেন, চলমান মহামারিকালকে বিবেচনায় না নিয়েও বলা যায়, ইন্টারনেট আমাদের জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু আবার মহামারির এ সময় আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের কতটা সঠিক হতে হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সরকার ও ইউরোপীয় সংসদের সদস্যরা ইউরোপীয় কমিশনের কাছে ডিজিটাল অধিকার ও নীতি প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছিল। এখন আমাদের কাছে এর একটা স্পষ্ট রূপ চলে এসেছে। ইউরোপীয় কমিশন গত মাসের শেষ দিকে ডিজিটাল অধিকার ও নীতির প্রস্তাবিত একটা ঘোষণা প্রকাশ করেছে। সে ঘোষণা মানুষকে প্রাধান্যে রেখে সাজানো হয়েছে। ডিজিটাল নীতি অবশ্যই মানুষকেন্দ্রিক হতে হবে এবং সেটা প্রণয়নের সময় কাউকেই বাদ দেওয়া যাবে না। ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক জীবনে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রাধান্য বিস্তারকারী ভূমিকায় চলে আসছে, আর সে জন্যই আমরা সবার জন্য নিরাপদ একটা ডিজিটাল মাধ্যম চাইছি। আমরা আশা করি, প্রস্তাবিত ঘোষণাটিতে আমাদের অধিকার ও মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা সম্ভব হবে।

মানুষকে প্রাধান্যে রাখা—এ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আমরা আমাদের প্রস্তাবিত নীতি ও অধিকারকে ছয়টি অধ্যায়ে ভাগ করেছি। প্রথমত, প্রযুক্তির একটা মূল্যবান উদ্দেশ্য থাকতে হবে। সেটা হলো আমাদের সেবা করা। এখানে আমরা অর্থ ডিজিটাল রূপান্তরের এ ক্রান্তিকালে মানুষ, যাঁরা এর কেন্দ্রে রয়েছেন। ডিজিটাল মাধ্যমে আমরা নিরাপদ থাকছি কি না এবং আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষা করা হচ্ছে কি না, সেটা আমাদের জানতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক সংহতিই এ ক্ষেত্রে মূল চাবি। মানুষের আরও ডিজিটাল হয়ে ওঠার মাধ্যমে প্রত্যেকেই যেন সেই বোধে উপনীত হতে পারে যে তারা ডিজিটাল মাধ্যমকে ধারণ করছে এবং এ মাধ্যম থেকে আরও বেশি লাভবান হতে পারছে। এ জন্য আমাদের প্রস্তাবিত রূপরেখায় ডিজিটাল শিক্ষা, সংযোগ ও ডিজিটাল সেবার প্রতি অঙ্গীকার করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবাও (মহামারিতে যেটা আমাদের অপরিসীম সহযোগিতা করেছে) এর অন্তর্ভুক্ত করা রয়েছে।

ডিজিটাল নীতি অবশ্যই মানুষকেন্দ্রিক হতে হবে এবং সেটা প্রণয়নের সময় কাউকেই বাদ দেওয়া যাবে না। ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক জীবনে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রাধান্য বিস্তারকারী ভূমিকায় চলে আসছে, আর সে জন্যই আমরা সবার জন্য নিরাপদ একটা ডিজিটাল মাধ্যম চাইছি। আমরা আশা করি, প্রস্তাবিত ঘোষণাটিতে আমাদের অধিকার ও মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা সম্ভব হবে।

তৃতীয়ত, মানুষের বেছে নেওয়ার স্বাধীনতার ওপর জোর আরোপ করা হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের সিদ্ধান্ত আগে থেকে নির্ধারণ করে দিতে পারে না। অ্যালগরিদম অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে। ডেটা স্যাম্পল যতটা সম্ভব কম পক্ষপাতমূলক হতে হবে। এ নীতি কেবল আমাদের অধিকার ও ব্যক্তিগত ভালোমন্দ বোধকেই সুরক্ষা দেবে না, আমাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থাকেও সুরক্ষিত রাখবে।

চতুর্থত, ডিজিটাল জনপরিসরে ব্যাপক অংশগ্রহণ আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। এটা আমাদের গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় পদক্ষেপ নিয়ে হোক কিংবা অবৈধ আধেয় অথবা মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে হোক, এ ক্ষেত্রে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক বিতর্ককে উদ্দীপিত করার জন্য আমরা অনলাইনে তথ্যের একটা সুসমন্বিত ব্যবস্থা (ইকোসিস্টেম) চাই। আমরা তথ্যের ফিল্টার বাবলস (গ্রাহকেরা কোনো তথ্য বা সংবাদ খুঁজলে সেটাই বারবার আসা) কিংবা তথ্যের বিভাজন ও মেরুকরণ চাই না। যে যে ভাষা জানে, সেই ভাষাতেই বিচিত্র তথ্য তার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

পঞ্চমত, নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়ন হচ্ছে এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিজিটাল প্রযুক্তি, পণ্য ও সেবায় সবার অধিগম্যতা থাকতে হবে। ডিজিটাল মাধ্যম সাইবার হামলা থেকে নিরাপদ থাকতে হবে। ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা যাতে সুরক্ষিত থাকে, সে ব্যবস্থাও থাকতে হবে। বিশেষ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অথবা ইন্টারনেট দ্বারা প্ররোচিত হয়ে শিশুরা সহজেই যেসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, সেগুলো বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে।

ষষ্ঠত, আমাদের চূড়ান্ত অগ্রাধিকার টেকসই একটি ব্যবস্থার প্রতি। আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে প্রযুক্তিপণ্যে যেন পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি থাকে। জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়, এমন প্রযুক্তিকে আমাদের উৎসাহ দিতে হবে। নতুন ব্যবসা মডেল, আরও কার্যকর সেবা ও ভালো সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেটা নিশ্চিত করা সম্ভব।

সংক্ষেপে ডিজিটাল এ ঘোষণা ইউরোপীয়দের দৈনন্দিন জীবনের বেশির ভাগটাকেই প্রভাবিত করে। জনগণকে বিভক্ত করার বদলে প্রযুক্তি কীভাবে মানুষকে একত্র করবে, এখানে সেটা ভাবা হয়েছে। এ নীতি ও অধিকারগুলো গ্রন্থিবদ্ধ করার মাধ্যমে ডিজিটাল রূপান্তরের একটা নকশা আমরা স্পষ্ট করেছি। ইউরোপের মাপকাঠিতে আমরা ডিজিটাল নীতি প্রণয়ন করতে যাচ্ছি। আমরা আশা করি, তথ্য সুরক্ষা ও ভোক্তা অধিকার সুরক্ষার জন্য বাকি বিশ্বে ডিজিটাল মাধ্যমের জন্য একই ধরনের পদক্ষেপ নেবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

মারগ্রেথ ভেসটাজি ইউরোপীয় কমিশনের নির্বাহী সহসভাপতি