মতামত

ইউপি নির্বাচনে মাফিয়াতন্ত্র

‘মাফিয়া’ শব্দটির সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। এর উৎপত্তিস্থল ইতালির সিসিলি। আভিধানিক অর্থ বাহাদুরি, নির্ভীকতা ইত্যাদি হলেও প্রচলিত অর্থে মাফিয়া বলতে সংগঠিত অপরাধী চক্র বা অপরাধী দলগুলোর জোটকে বোঝানো হয়। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি দেশবাসীকে সেই মাফিয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচন ছিল উৎসবমুখর। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে হেরে গেলে যেহেতু সরকার পরিবর্তনের কোনো ঝুঁকি নেই, তাই নির্বাচিত সরকার তো বটেই, এমনকি স্বৈরাচারী হিসেবে খেতাবপ্রাপ্ত সরকারের আমলেও এই নির্বাচনগুলো অন্তত সুষ্ঠু হতো। স্বৈরাচারী সরকার একধরনের গণতান্ত্রিক বিভ্রম তৈরির জন্য হলেও এই নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু হতে দিত। একই পরিবার থেকে কয়েকজন সদস্যের বিভিন্ন মার্কায় দাঁড়ানো ছিল খুবই পরিচিত দৃশ্য। এসব নির্বাচনকে কখনো অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে গণ্য করেনি কেউ।

বাংলাদেশের বহু পরিবর্তনের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনকেও অস্তিত্বের লড়াই বানিয়ে ফেলা। বর্তমানে চলা ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সহিংসতা, ভোটারদের হুমকি দেওয়া, প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি দেখানো, জালিয়াতি, ভোট চুরি ও নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘনের এক মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হওয়া পাঁচ ধাপের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৩৫৪, সাধারণ ওয়ার্ড সদস্য ৮৫৮, সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্য ৩৬৪ জনসহ মোট ১ হাজার ৫৭৬ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

এবারের ইউপি নির্বাচনে কুমিল্লার লাকসাম আর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা অতি আলোচিত ছিল। লাকসাম উপজেলার ৫টি ইউপির নির্বাচনে চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদে মোট ৬৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। অন্যদিকে রাউজান উপজেলায় ১৪টি ইউপিতে চেয়ারম্যান, ১২৬ জন পুরুষ সদস্য ও ৪২ জন সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো উপজেলায় চেয়ারম্যান ও সদস্যের ১৮২টি পদে নির্বাচিত হতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয়নি। ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার মডেলটি এখন ছড়িয়ে পড়েছে জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে।

বর্তমান বাংলাদেশে ‘স্থানীয় শাসন’-এর সর্বনিম্ন স্তরটিতে যা ঘটছে, সেটা প্রমাণ করে, এখানে এখন আসলে আর কোনো সত্যিকার জনপ্রতিনিধি নেই, নেই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন। আছেন একেকজন মাফিয়া, যাঁরা ক্ষমতায় আসতে পারলে যাবতীয় অবৈধ কারবারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে পারেন।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন এতই মরিয়া যে এখন অভিনব পদ্ধতির জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়ছেন তাঁরা। শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিতলিয়া ইউপির নির্বাচনে চেয়ারম্যান, সংরক্ষিত মহিলা সদস্য ও সাধারণ সদস্য—সবাইকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করানোর জন্য স্বাক্ষর জাল করে অন্যদের বৈধ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ওই উপজেলার রিটার্নিং কর্মকর্তার বক্তব্য অনুসারে এটা করা হয়েছিল সাংসদের নির্দেশে। তাঁর ফাঁস হওয়া একটি অডিওতে বলতে শোনা যায়, ‘এমপি সাহেব বলেছেন চিতলিয়ায় কোনো ভোট হবে না। এখানে সবাই সিলেক্টেড।’ নির্বাচন কমিশনের তদন্তে এই জালিয়াতির সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত করা হয়। অবিশ্বাস্যভাবে এই ভয়ংকর দুর্নীতির জন্য সেই ‘এমপি সাহেব’ দূরেই থাকুক, রিটার্নিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও কোনো ফৌজদারি ব্যবস্থার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।

বাংলাদেশে নির্বাচনে আচরণবিধি আছে বলে আর মনে হয় না। না হলে যে ভাষায় নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন সরকারি দলের প্রার্থী কিংবা নেতারা, তাতে বহু আগেই এই নির্বাচন বন্ধ হওয়ার কথা। নিদেনপক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু সে ধরনের কিছু হয়েছে বলে শোনা যায়নি।

‘মাইন্ড ইট নৌকার ভোট হবে ওপেনে’, ‘নৌকার বিরুদ্ধে গেলে কারও বাঁচন নাই’, ‘নৌকায় ভোট না দিলে এলাকা ছাড়ুন’, ‘ভোটের দিন শুধু একে-৪৭ নিয়ে আসা না—প্রয়োজনে আর যা করার সব করা হবে’, ‘নৌকায় ভোট না দিলে কবরস্থানে জায়গা হবে না—মসজিদে নামাজ পড়তে দেওয়া হবে না’, ‘দরকার হলে ১০টা মার্ডার করে আসতে হবে’, ‘নৌকার বাইরে ভোট দিতে দেওয়া হবে না, নৌকার বিরুদ্ধে ভোট চাইলে অবরোধ করে রাখা হবে’, ‘নৌকার ভোট নেওয়া হবে পিটিয়ে পিটিয়ে’—এমন সব মন্তব্য এখন প্রতিদিনকার খবর।

অনেকেই ভাবতে পারেন এগুলো স্রেফ কথার কথা কিংবা মেঠো বক্তৃতা। কিন্তু আসলে তা নয়। এই নির্বাচনে সরকারি দলের নৌকা মার্কার প্রার্থী আর বিদ্রোহী প্রার্থীর সংঘাতে ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ১১৩ জন। আহত হয়েছেন ৭ হাজারের বেশি মানুষ। সরকারি দল করলেও তাঁরা সব খুব সহজে ‘খরচযোগ্য’ মানুষ। পাঁচ বছর আগের ইউপি নির্বাচনটিতে হত্যার শিকার হওয়া দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যুর বিচার দূরেই থাকুক, মামলাও চলছে না কোনোটির।

মাফিয়ারা ভয়ংকর সব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়, ঝুঁকি নেয় এবং বহু ক্ষেত্রেই জানে, হয় মারতে হবে, না হলে মরতে হবে। এই ঝুঁকি তারা নেয়, কারণ, এ ক্ষেত্রে স্টেকটা অনেক বড়। জিততে পারলে পুরো এলাকার কর্তৃত্ব তাদের আর তাই এত মরিয়া তারা। মাদক পাচার, খুন, চাঁদাবাজি, চোরাচালান, মানি লন্ডারিং থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই, যার সঙ্গে তারা যুক্ত নয়। তারা নিয়মিত মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক মাসোহারা নিয়ে অন্য সন্ত্রাসীদের হাত থেকে তাদের একধরনের নিরাপত্তা বিধান করে, সব রকম অবৈধ ও বেআইনি লেনদেনের মধ্যে সমন্বয় করে, অপরাধীদের মধ্যে সমস্যা হলে সেটার মধ্যস্থতা করে। নিঃসন্দেহে এগুলো রাষ্ট্র-সমাজের চোখে অপরাধ, কিন্তু এগুলোই তাদের এনে দেয় অকল্পনীয় উপার্জনের সুযোগ, অবিশ্বাস্য ক্ষমতার স্বাদ।

বর্তমান বাংলাদেশে ‘স্থানীয় শাসন’-এর সর্বনিম্ন স্তরটিতে যা ঘটছে, সেটা প্রমাণ করে, এখানে এখন আসলে আর কোনো সত্যিকার জনপ্রতিনিধি নেই, নেই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন। আছেন একেকজন মাফিয়া, যাঁরা ক্ষমতায় আসতে পারলে যাবতীয় অবৈধ কারবারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে পারেন। প্রথাগত মাফিয়াদের চেয়ে তাঁদের ‘নৈতিক শক্তি’ অনেক বেশি, কারণ, তাঁরা দাবি করতেই পারেন—শুধু গায়ের জোর নয়, রীতিমতো ‘জনগণের ম্যান্ডেট’ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন তাঁরা।

সাম্প্রতিক কালে ইউপি নির্বাচন হচ্ছে বলে এই নির্বাচন নিয়ে আলোচনাটি করলাম। একই কারণে একই পরিস্থিতি ঘটে অন্যান্য স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা) নির্বাচনেও। শুধু স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন, স্টেক অকল্পনীয় রকম উঁচু বলেই এই দেশে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলার মতো অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটানো হয়।

  • রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী