মতামত

ইউক্রেন সংকট মস্কো-বেইজিংকে আরও কাছে আনছে

উষ্ণতম মুহূর্তে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
 ছবি: এএফপি

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর থেকে পশ্চিমের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক কতটা তিক্ত হবে, তা নিয়ে বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। মস্কো ও পশ্চিমা রাজধানীগুলোর কর্মকর্তারা কাদা-ছোড়াছুড়ি করছেন। পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও এ যুদ্ধের কারণে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, তা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাশিয়া ও চীন উভয়ই প্রকাশ্যে তাদের ক্রমবর্ধমান অংশীদারত্বের কথা প্রচার করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে তাঁর ‘সবচেয়ে ভালো বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছেন। এ ছাড়া সি চিন পিং ও পুতিন উভয়েই চীন-রাশিয়া সম্পর্কের বর্তমান অবস্থাকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো অবস্থা’ বলে বর্ণনা করেছেন।

ইউক্রেনের বর্তমান সংকটকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলায় চীন ও রাশিয়া তাদের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার মূল আগ্রহ ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদান থেকে বিরত রাখা। অন্যদিকে চীন চায় এ সুযোগে রাশিয়ার মাধ্যমে আমেরিকান প্রভাবকে খাটো করে ফেলতে।

দুই দেশের যৌথ সামরিক মহড়া, অস্ত্র ও জ্বালানি চুক্তি বৃদ্ধি, দুই দেশের রাষ্ট্রচালিত গণমাধ্যমে পরস্পরের প্রতি জনসমর্থন এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে তাদের সহযোগিতামূলক লেনদেনে এ বন্ধুত্ব প্রতিফলিত হয়েছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করার পর থেকে মস্কো পশ্চিমাদের আরোপিত কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সীমিত করার জন্য বেইজিংয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের উন্নতির কথা প্রচার করতে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

ইউক্রেনের বর্তমান সংকটকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলায় চীন ও রাশিয়া তাদের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার মূল আগ্রহ ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদান থেকে বিরত রাখা। অন্যদিকে চীন চায় এ সুযোগে রাশিয়ার মাধ্যমে আমেরিকান প্রভাবকে খাটো করে ফেলতে।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় ‘রাশিয়ার আর্থিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু এবং দেশটির ধনী নাগরিকদের ক্ষতি করতে’ মস্কোর ওপর পশ্চিমারা অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশেষ করে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড বিশ্বব্যাপী ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) ব্যবস্থা থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়ায় মার্কিন আধিপত্যশীল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প ব্যবস্থা বিকাশে চীন ও রাশিয়া উভয়ই এই খাতে আরও বেশি বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়েছে। উভয়ই তাদের নিজস্ব আন্তর্জাতিক অর্থ প্রদানের ব্যবস্থায় বিনিয়োগ শুরু করেছে।

এই নতুন আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেমগুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার সিস্টেম ফর ট্রান্সফার অব ফাইন্যান্সিয়াল মেসেজেস (এসপিএফএস) ও ন্যাশনাল পেমেন্ট কার্ড সিস্টেম (এখন এটি ‘মির’ নামে পরিচিতি পেয়েছে)। এ ছাড়া চীনের আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেমগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম (চিপস) ও ইউনিপে। রাশিয়ান ও চীনা ব্যাংকগুলো এসব প্ল্যাটফর্মজুড়ে সক্রিয়। রাশিয়া ও চীনে এই বিকল্প ব্যবস্থাগুলো ব্যবহার করা ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ছে। এর কারণ, দুটি দেশই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রেখে সম্পর্ক ‘গভীর’ করতে চায়।

পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্থব্যবস্থার বিকল্প পন্থার বিকাশকে উৎসাহিত করার ফলে এসব ব্যবস্থায় কালোবাজারে ব্যবসা করতে অভ্যস্ত কথিত ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের’ অংশগ্রহণ বাড়বে। গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের কয়েক সপ্তাহ আগে বেইজিং ও মস্কো একটি নতুন পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে গ্যাস সরবরাহের জন্য ৩০ বছরের চুক্তি করেছে। এ চুক্তির আওতায় চীন ও রাশিয়ার লেনদেন হবে ইউরোতে। এটি মার্কিন ডলারের প্রতি তাদের নির্ভরশীলতা কমাতে সহায়তা করবে।

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর শত শত পশ্চিমা কোম্পানি রাশিয়া থেকে তাদের ব্যবসা ‘প্রত্যাহার’ করার অভিপ্রায় ঘোষণা করায় মস্কো বলেছে, তারা ওই বিদেশি কোম্পানিগুলোর অবকাঠামো জাতীয়করণ এবং তাদের পেটেন্ট সুরক্ষা আত্তীকরণ করবে। এসব পশ্চিমা সম্পদ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার চীনের জন্য কাজে লাগতে পারে।

রাশিয়ার মিডিয়া আউটলেটগুলো বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ নিষিদ্ধ করার পর চীনের রাষ্ট্রচালিত মিডিয়া রাশিয়ার মতামত প্রচার করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ইউক্রেনে জীবাণু অস্ত্র পরীক্ষাগারে অর্থায়ন করছে’ বলে রাশিয়া যে দাবি করে আসছে, তা সমর্থন করছে। তবে ইউক্রেনের বর্তমান উত্তেজনা বৃহত্তর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে বাড়িয়ে তুলেছে এবং রাশিয়ার আক্রমণ থেকে উদ্ভূত বেশ কিছু তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি চীন-রাশিয়া অংশীদারত্বে কিছুটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যেমন রুশ আগ্রাসনের কারণে এখন ইউক্রেন থেকে চীন ভুট্টা আমদানি করতে পারছে না। এ ছাড়া রাশিয়াকে চীনের সহায়তা বেইজিংয়ের সঙ্গে তার নিজস্ব বিরোধ নিয়ে চীনের প্রতিবেশীদের মধ্যে ভয় তৈরি করবে। এটি চীনের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।

এ বাস্তব এবং সম্ভাব্য পরিণতি সত্ত্বেও চীন ও রাশিয়া বৃহত্তর সহযোগিতার সূচনা করেছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • জন পি রুয়েল ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান সাংবাদিক ও লেখক