ইউক্রেন সংকটে রাশিয়াকে কতটা সমর্থন দেবে চীন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট িস চিন পিং
 ছবি: রয়টার্স

দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার পর ইউক্রেনে সেনা অভিযান শুরু করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এখন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী পদক্ষেপ নেয়, সেটাই সবার মনোযোগের বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে।

২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার পর যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তাতে রাশিয়ার অবস্থানের সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিল চীন। কিন্তু এবারের সংকটে চীনের অবস্থান যেমন গুরুত্বপূর্ণ, আবার জটিলও। বেইজিংয়ের ঐতিহাসিক অবস্থান এবং কৌশলগত হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় নিলে চীন যে স্পষ্ট অবস্থান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অবস্থান নেবে না, সেটা বলা যায়। এ ক্ষেত্রে চীনের লাভ-ক্ষতি এবং কৌশলগত অবস্থান বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ।

ধারাবাহিকতা ও পরিবর্তন

ইউক্রেন সংকটে চীনের যে প্রতিক্রিয়া, সেটা অনেকটাই ‘কৌশলে এড়ানোর কৌশল’। চীন সব পক্ষকে সংযম প্রদর্শন, উত্তেজনা প্রশমন এবং আলোচনার ভিত্তিতে মতপার্থক্য নিরসনের আহ্বান জানিয়েছে। ক্রিমিয়া ও পূর্ব ইউক্রেন সমস্যা—দুই ক্ষেত্রেই বেইজিং এর যে জটিল ঐতিহাসিক বাস্তবতা রয়েছে, সেদিকটাতে গুরুত্ব দিয়েছে। দুই পক্ষই যে ঘটনার জন্য দায়ী, সেটা বলতে চেষ্টা করেছে চীন। ইউক্রেন সংকটে চীনের অবস্থান আগের অবস্থান (ক্রিমিয়া সংকট) থেকে কিছুটা ভিন্ন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বিবৃতিতে সব পক্ষের যৌক্তিক নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের বিষয়টাতে সম্মান প্রদর্শনের কথা বলেছেন। এর মধ্য দিয়ে চীনের ভারসাম্য নীতির প্রতিফলন ঘটেছে। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যে নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং ন্যাটো সম্প্রসারণের মুখে রাশিয়ার যে নিরাপত্তা উদ্বেগ—দুটিই এখানে উঠে এসেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই তাঁর বিবৃতিতে ইউক্রেনসহ সব দেশের সার্বভৌমত্ব ও সীমানাগত অখণ্ডতা রক্ষার কথা বলেছেন। এ বক্তব্য ইউক্রেন সংকটে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে স্পষ্ট অবস্থান বলে বিবেচিত হতে পারে। ইউক্রেনের আজকের সংকট মিনস্ক-২ চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যর্থতা থেকে উদ্ভূত বলে মনে করে চীন। তবে চীন এটাও মনে করে যে মিনস্ক চুক্তি আসলে একটা প্রহেলিকা; অর্থাৎ এ ব্যর্থতার জন্য দুই পক্ষই দায়ী। বিবৃতিতে চীন দাবি করেছে, ঘটনার গুরুত্ব অনুযায়ী নিজেদের অবস্থানের বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেবে। বিবৃতির শেষে থাকলেও বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ মাসের শুরুর দিকে বেইজিংয়ে চীন-রাশিয়া সম্পর্কের বিষয়ে পুতিন ও সি চিন পিং যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন, চীনের বর্তমান অবস্থান সেটার পরিপন্থী। ওই বিবৃতিতে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে ‘কোনো সীমা’ নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।

চীনের হিসাব-নিকাশ

২২ ফেব্রুয়ারি ভোরটি ছিল চীনের পররাষ্ট্রবিষয়ক নীতিনির্ধারকদের কাছে একটা বড় ধাক্কা। তাঁরা মনে করতেন, পুতিন শুধু যুদ্ধের ভান করছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য ভুল। রাশিয়া যে সত্যি সত্যি আগ্রাসন শুরু করবে, সেটা চীনাদের ধারণাতেও ছিল না। চীন মনে করত, পুতিনের ‘যুদ্ধসজ্জা’ যে নীতি, তাতে তিনি সফল। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা গেছে, ন্যাটো জোটের মধ্যে একটা দ্বিধা তৈরি করা গেছে ও জ্বালানির দাম বাড়ানো গেছে। ন্যাটো সম্প্রসারণ প্রক্রিয়াও ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

রাশিয়া যে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালাতে পারে, সে সম্ভাবনা চীন উড়িয়ে দিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, রাশিয়ার প্রতি তাদের পূর্বানুরাগ। দ্বিতীয়ত, ইউরোপের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে তাদের স্বেচ্ছানির্বাসন। চীন এখনো জানে না রাশিয়ার কর্মকাণ্ড প্রাচ্যে সরাসরি কী প্রভাব ফেলতে পারে। ইউক্রেন পরিস্থিতি চীন দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছে। রাশিয়ার সঙ্গে দেওয়া যৌথ বিবৃতিটাই প্রমাণ করে, পুতিনের পদক্ষেপ বুঝে উঠতে কতটা ব্যর্থ হয়েছে চীন। বেইজিং যদি আগে থেকে বুঝতে পারত, পুতিন ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করতে যাচ্ছেন, তাহলে যৌথ বিবৃতির দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতো তারা। যদিও চীনের অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন, যাঁরা মনে করেন, রাশিয়া যা করছে, তাতে চীনের জন্য কৌশলগত লাভই হবে। ইউক্রেন সংকট যুক্তরাষ্ট্রকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে ইউরোপ এবং আটলান্টিক মহাসাগরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

চীনের অবস্থানের বদল হবে কি?

যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই রাশিয়া সম্পর্কিত চীনের নীতি বদলাতে পারবে না। চীন কখনোই রাশিয়ার অবস্থানের সরাসরি বিরোধিতা করবে না। রাশিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে এমন কোনো সহযোগিতা তারা করবে না, যাতে যুক্তরাষ্ট্র অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। অনেক চীনা বিশেষজ্ঞ ভুল ধারণা পোষণ করছেন। তাঁরা মনে করছেন, গত কয়েক বছরে বাণিজ্যযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, সেটার চেয়ে রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে, সেটা তেমন বড় কিছু নয়। এ দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অংশীদার চীন। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কও বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিযোগিতার জন্য চীন রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী করেছে এবং তাদের সমর্থন জুগিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তব কোনো কারণে সেই সম্পর্ক যদি ভারী বোঝা হয়ে যায়, তবে বেইজিং অবশ্যই সেটা পুনর্বিবেচনা করবে। চীন-রাশিয়ার মৈত্রী শুরু হয়েছে তাদের যৌথ মার্কিনবিরোধী অবস্থান থেকে। কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলে পার্থক্য রয়েছে।

ইংরেজি থেকে নেওয়া, এশিয়া টাইমস থেকে অনূদিত

  • ইয়ান সান সিনিয়র ফেলো এবং স্টিমসন সেন্টার থিঙ্কট্যাংকের চীন ও পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সহপরিচালক