ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে প্রচলিত গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সময় এসেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার অবৈধ ও নৃশংস আগ্রাসন চতুর্থ মাসে প্রবেশ করেছে। ইউরোপ, দক্ষিণ গোলার্ধ ও সারা বিশ্বের ওপর এ যুদ্ধের গভীরতর প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। আমরা একটা নতুন রাজনৈতিক বা সামরিক বিশ্বব্যবস্থার জন্ম হতে দেখছি।
এ যুদ্ধের ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে, অন্যান্য সম্পদেরও চাহিদা বেড়েছে। ফলে খাদ্যপণ্য ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। বিশ্বের একটা বড় অংশ দুর্ভিক্ষের মুখে। বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি হয়েছে শরণার্থী সংকট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব এখন সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট মোকাবিলা করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ যত প্রলম্বিত হবে, ততই পারমাণবিক দুর্ঘটনা কিংবা যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়বে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন রাশিয়াকে ‘দুর্বল’ করে দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করেছেন। ইউক্রেনকে জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। গোয়েন্দা তথ্য দিয়েও তারা ইউক্রেনকে সহায়তা করছে। এতে স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো রাশিয়ার সঙ্গে একটি প্রক্সি যুদ্ধে রত।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে প্রচলিত গোঁড়া ধারণাগুলোর বাইরে যাঁরা চিন্তা করেন, তাঁদের প্রান্তিক করে ফেলা হচ্ছে। প্রভাবশালী বহুজাতিক গণমাধ্যমে তাঁদের খুব কমই জায়গা দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে বিকল্প ও ভারসাম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরের অস্তিত্ব কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না
এই প্রক্সি যুদ্ধের ফলে যে অপ্রত্যাশিত দুর্দশা ও বহুমুখী ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, সেটা কি গণমাধ্যমের মূল খবর হওয়া উচিত নয়? গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ, আলোচনা ও বিতর্কের সেটা কতটুকু প্রাধান্য পাচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আলোচনায় আমরা কি সেটা দেখতে পাচ্ছি? সিংহভাগ ক্ষেত্রেই একপেশে অবস্থান। এমনকি জনপরিসরে যে আলোচনা ও বিতর্ক চলছে, তারও কোনো ছাপ গণমাধ্যমে নেই। এ পরিস্থিতিকে সাংবাদিক ম্যাট তাইবি ‘বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যস্থান’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে প্রচলিত গোঁড়া ধারণাগুলোর বাইরে যাঁরা চিন্তা করেন, তাঁদের প্রান্তিক করে ফেলা হচ্ছে। প্রভাবশালী বহুজাতিক গণমাধ্যমে তাঁদের খুব কমই জায়গা দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে বিকল্প ও ভারসাম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরের অস্তিত্ব কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিহাস ও দৃষ্টিভঙ্গির আরও বৈচিত্র্যকরণ কি এই ‘নিশ্চিত পক্ষপাতমূলক’ দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকর নয়? ইউক্রেনের এই ট্র্যাজেডি অনিবার্য করে তোলার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের ভূমিকা ও ইতিহাস নিয়ে যে দু–একজন কথা বলছেন, তাঁদের কেউই রাশিয়ার অপরাধমূলক আক্রমণের পক্ষে সাফাই গাইছেন না। নোয়াম চমস্কি, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মের্শাইমার, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত চাজ ফ্রিম্যানসহ অন্য বুদ্ধিজীবী যাঁরা যুদ্ধের পেছনের ইতিহাস ও পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরে অকাট্য তথ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করছেন, তাঁদের সাক্ষাৎ শয়তান হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। অথবা তাঁদের ওপর নানাভাবে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা চলছে।
আমেরিকার ভঙ্গুর গণতন্ত্রে ভিন্নমতের মূল্য তুলনামূলকভাবে কম। ইউক্রেনে আরও অস্ত্র পাঠানো কি আমেরিকার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে—এ প্রশ্ন তোলা কি মূল্যহীন কোনো কাজ? পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কাকে কীভাবে কমানো যায়, সে বিষয়ে আরও আরও প্রশ্ন তোলা এবং আলোচনা করা কি তাহলে গুরুত্বহীন বিষয়? ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদী, অতি ডানপন্থী এবং নব্য নাৎসিবাদীদের ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ও ইতিহাস থাকার পরও কেন প্রথাবিরোধী বলে পরিচয় দেওয়া বুদ্ধিজীবীরা একদম চুপ করে বসে আছেন? ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশে ফ্যাসিবাদ ও নব্য নাৎসিবাদের পুনর্জাগরণ ঘটছে। ফ্যাসিবাদ ও নব্য নাৎসিবাদ ওই দেশগুলোর জন্য বিষাক্ত একটা পরিবেশ সৃষ্টি করছে। ইউক্রেনের এই ইতিহাস কেন উপেক্ষা করা হবে?
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সাবেক একজন জেনারেল একসময় বলেছিলেন, যুদ্ধ হচ্ছে একটা চক্র। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র কোম্পানিগুলো এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরিপুষ্ট হয়ে উঠছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই অনেক ইউক্রেনীয় এবং রাশিয়ান মারা যাবেন, কিন্তু তাতে রেথিয়ান, লকহেড মার্টিন ও নর্থরোপ গ্রুম্যানের মতো অস্ত্র কোম্পানির ভাগ্য খুলে যাবে। একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞে পূর্ণ হয়ে গেছে। খুব সঠিকভাবে বলতে গেলে, সামরিক কর্মকর্তারা এখন সেখানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁদের পরিচয় কিংবা তাঁদের নিয়োগকর্তা কারা, সেসব তথ্য পাঠকের কাছে প্রকাশ করা হচ্ছে না।
আমেরিকার টেলিভিশন অথবা ইন্টারনেটের পর্দায় অথবা আইনসভায় বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা বিকল্প স্বরের অস্তিত্ব খুব কমই দেখা যায়। আলাপ-আলোচনা কিংবা কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা তুলে ধরেন, এমন ব্যক্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রায় এক দশক ধরে চলা ইরাক যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পর, জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস ওয়াশিংটন পোস্ট–এর লেখক রিক অ্যাটকিনসনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আমাকে বলুন এ যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে।’ ইউক্রেন যুদ্ধ পরিসমাপ্তির জন্য প্রচলিত গোঁড়া চিন্তার বিপরীতে নতুন চিন্তা প্রয়োজন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় মার্কিন সাংবাদিক ওয়াল্টার লিপম্যান একসময় বলেছিলেন, ‘যখন সবাই একভাবে চিন্তা করে, তখন আসলে কেউই কিছু চিন্তা
করে না।’
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ক্যাটরিনা ভ্যানডেন হিউভেল ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার কলাম লেখক