এমন তো নয় যে কেউ বিড়াল চেনে না কিংবা হাতে ঘণ্টা নেই, কিন্তু তবু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে দেখছি না তেমন কাউকে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে যখন আমাদের দেশে আলাপ হচ্ছে, তখন দেশের বিশেষজ্ঞরা তাঁদের আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখছেন মূলত দুটি জায়গায়। প্রধান আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশের ওপর যুদ্ধের সময়ে কী অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ছে, সেটা নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন বাংলাদেশকে এখন কীভাবে বিবদমান দুই পরাশক্তির মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে, সে বিষয়ে। অথচ এ ঘটনার এক সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব আছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, যা এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
ইউক্রেনের যুদ্ধে জয়-পরাজয় যারই হোক না কেন, সামনে যে বিশ্বের অনেক কিছুই বদলে যাবে তা নিশ্চিত। যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দেখছি জার্মানি তার প্রতিরক্ষা ব্যয় এক দফায় দ্বিগুণ করেছে। এই যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা অনিবার্যভাবেই পৃথিবীতে নতুন করে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করতে যাচ্ছে। রাষ্ট্রগুলো তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি করা মানে হচ্ছে তারা তাদের নাগরিকদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা কিংবা ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের মতো খাতগুলোতে বরাদ্দ কমাবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যবস্থায় নতুন মেরুকরণ তৈরি করতে যাচ্ছে। এই আলোচনা বিশ্বজুড়েই হচ্ছে যে ইউক্রেন সংকট পশ্চিমাদের প্রভাবিত বিশ্বব্যবস্থাকে সংহত করবে, নাকি চীন-রাশিয়ার প্রভাবিত বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। এমন যদি ঘটে, তাহলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দেশগুলোর বিপরীতে কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর প্রভাব অনেক বেড়ে যাবে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আনা একটি প্রস্তাব তার কিছুটা ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট দেওয়া পাঁচটি দেশই কর্তৃত্ববাদী। ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকা দেশের মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র আছে পাঁচটি দেশে। ৯টি দেশ আধা কর্তৃত্ববাদী (হাইব্রিড রেজিম)। আর পূর্ণ কর্তৃত্ববাদী দেশের সংখ্যা ২০টি। তবে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়া দেশগুলোর মধ্যেও কর্তৃত্বপরায়ণ দেশ রয়েছে। এই ব্যতিক্রমটুকু সরিয়ে রাখলে আমরা দেখতে পাই রাশিয়ার পক্ষে থাকা দেশের সরকারগুলোর অগ্রাধিকারের তালিকায় গণতন্ত্রচর্চা প্রায় নেই।
ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার পক্ষে বাংলাদেশ যে যুক্তিটি দিয়েছে, তা হচ্ছে প্রস্তাবে নাকি রাশিয়াকে দোষারোপ করা হয়েছে। সঙ্গে অবশ্য যুক্ত করা হয়েছে, বাংলাদেশ যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হুমকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই দেশে সামরিক অভিযান চালানো কি নিন্দা করার যোগ্য নয়?
নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, এখানে মূল অভিযুক্ত দেশ রাশিয়ার নিজেরই ভেটো ক্ষমতা রয়েছে এবং রাশিয়া তা প্রয়োগও করেছে। আর সাধারণ পরিষদে নেওয়া প্রস্তাব আদতে রাশিয়ার যুদ্ধের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে এর একটি প্রতীকী ও নৈতিক মূল্য আছে। আমরা সেই প্রতীকী মূল্যকেও গুরুত্ব দিইনি।
বিশ্লেষকদের অনেকে বাংলাদেশে রাশিয়ার ঋণে পরিচালিত কিছু প্রকল্প, বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তাঁরা মনে করেন, এর অর্থায়ন নিশ্চিত করে প্রকল্প শেষ করার তাগাদা বাংলাদেশের রয়েছে। কিন্তু এর পাল্টা যুক্তিও খুব জোরালো, এই প্রকল্প শেষ করার তাগাদা রাশিয়ারই থাকবে, কারণ এটা কোনো ‘খয়রাতি’ প্রকল্প নয়, বরং ঋণ, যা আমাদের শোধ করতে হবে। এখানে রাশিয়ার স্বার্থও কম নয়। যেসব দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে, তাদের সঙ্গেও রাশিয়ার কমবেশি অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। এদের মধ্যে শুধু পশ্চিমা বিশ্বের নয়, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশও আছে। তারা নিশ্চয়ই অর্থনৈতিক কারণকে দেখিয়ে ভোটদানে বিরত থাকেনি।
বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশই কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। প্রতিটি দেশকে কিছু আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত রীতিনীতি মানতে হয়। র্যাব এবং এর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড বন্ধে ভূমিকা রাখতে পেরেছে আপাতত। অথচ এই হত্যা বন্ধে দেশের সব মানবাধিকার সংস্থা, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ মিলে ভীষণ শোরগোল করেও সফল হতে পারেনি।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিশ্বব্যাপী নির্বাচনী গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছেন, যা তাঁর পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপরীত। কিছুদিন আগেই র্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আমাদের দেশের আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এ ছাড়া ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমেরিকার কৌশল’ (ইউনাইটেড স্টেটস স্ট্র্যাটেজি অন কাউন্টারিং করাপশন) নামে একটি পূর্ণাঙ্গ কৌশলপত্র আমেরিকা তৈরি করেছে গত বছরের ডিসেম্বরে। এই কৌশলপত্রের অধীনেই যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে দেশের বাইরের দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও তাদের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা আছে। এর একটা প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতি করে টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে।
আরেকটি জাতীয় নির্বাচন এসেছে আমাদের দোরগোড়ায়। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে, নির্বাচনের মান নিয়ে আমেরিকার দিক থেকে সরকারের ওপর চাপ আসতে পারে। কিছুদিন আগে নিকারাগুয়ার কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের নির্বাচনী কারসাজির কারণে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিরুদ্ধেও আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের পদক্ষেপ মোকাবিলায় সরকার হয়তো একধরনের জাতীয়তাবাদী চেতনা উসকে দেওয়ার চেষ্টা করবে এবং নাগরিকদের কেউ কেউও সেভাবেই ভাবেন। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশই কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। প্রতিটি দেশকে কিছু আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত রীতিনীতি মানতে হয়। র্যাব এবং এর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড বন্ধে ভূমিকা রাখতে পেরেছে আপাতত। অথচ এই হত্যা বন্ধে দেশের সব মানবাধিকার সংস্থা, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ মিলে ভীষণ শোরগোল করেও সফল হতে পারেনি।
দীর্ঘদিন থেকেই পৃথিবীতে গণতন্ত্রের ভাটার টান চলছে। পরিসংখ্যান বলে পৃথিবীতে কার্যকর গণতন্ত্রের সংখ্যা ২০০৬-এর পর প্রতিবছর কমছে। এমনকি আমাদের চোখে আদর্শ উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও ডানপন্থী, পরিচয়বাদী, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি খুব ভালোভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে। এখন যদি বিশ্বজুড়ে চরম কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর প্রভাবিত বিশ্বব্যবস্থা কার্যকর হয়, উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর গণতন্ত্রের ক্ষয় যেমন অনেক ত্বরান্বিত হবে, তেমনি আধা কর্তৃত্ববাদী (হাইব্রিড রেজিম) এবং কর্তৃত্ববাদী দেশের সংখ্যা বাড়বে অতিদ্রুত। এর মধ্যেই যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদ প্রায় বা পুরোপুরি জাঁকিয়ে বসেছে, সেসব দেশের পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর দিকে চলে যাবে। এই দেশের অনেক মানুষ ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকাকে শায়েস্তা করা যাচ্ছে বলে রাশিয়াকে সমর্থন দিচ্ছেন। এসব করতে গিয়ে নিজ দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা সম্ভবত তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন।
● রুমিন ফারহানা বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী