গত ১১ মে নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি কলামে বলা হয়েছিল, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সবকিছু ঠিকমতো যাচ্ছে না। সেখানে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল, ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পাল্টে যেতে পারে। এরপর গত ১৯ মে নিউইয়র্ক টাইমস-এর ‘সম্পাদকীয় পর্ষদ’ ইউক্রেন যুদ্ধে অবস্থান বদলের ক্ষেত্রে ইঙ্গিত থেকে বের হয়ে সরাসরি অবস্থান ব্যক্ত করেছে। সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল, ‘যুদ্ধ জটিল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে, এবং যুক্তরাষ্ট্র এর জন্য প্রস্তুত নয়।’
নিউইয়র্ক টাইমস এর মতামত পাতার শুরুতেই সম্পাদকীয় পর্ষদ বলে দেয়, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে পুরো জয় পাওয়াটা সম্ভব নয়। ‘বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের ‘সীমাবদ্ধতা’-এর ভিত্তিতে ইউক্রেনকে শান্তির পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। নিউইয়র্ক টাইমসে আমেরিকার অভিজাত সম্প্রদায়ের মতামতের প্রতিফলন ঘটে। সে জন্য তাদের এই সম্পাদকীয়কে হালকাভাবে নেওয়া যাচ্ছে না।
সম্পাদকীয় পর্ষদ বলেছে, ‘মার্চ মাসে আমরা যুক্তি দিয়েছিলাম, যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের পক্ষ থেকে ইউক্রেনীয় ও রুশদের প্রতি বার্তাটি একই। সেটা হলো, কত দিন লাগবে, সেটা ব্যাপার নয়, ইউক্রেনকে মুক্ত হতে হবে।’ ‘সেই লক্ষ্য এখন বদল হয়নি, কিন্তু উপসংহার টানছি, রাশিয়ার সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এখন আমেরিকার সর্বোত্তম স্বার্থ নয়। এমনকি শান্তি আলোচনার জন্য কিছু কঠোর ছাড় যদি দিতে হয়, সেটাও ইউক্রেনের নেওয়া প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে কোনো অস্পষ্টতা না রেখে সম্পাদকীয় পর্ষদ ঘোষণা করে, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন নিষ্পত্তিমূলক সামরিক জয় চায়। সেটা হলো, ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের যেসব ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে, সেটা পুনরুদ্ধার করা। এটা কোনো বাস্তবসম্মত উদ্দেশ্য হতে পারে না। রাশিয়া এখনো অনেক বেশি শক্তিশালী।’
রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মান এখন যুদ্ধ শুরুর আগের থেকে বেশি। গত দুই বছরের মধ্যে এখন রুবল সবচেয়ে শক্তিশালী। মার্চে ডলারের বিপরীতে রুবলের দর যেখানে ১৫০-এ উঠেছিল, এখন সেটা ৫৯-এ নেমেছে। রাশিয়ায় এ বছর ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে। দেশটির গম, সার, তেল ও গ্যাসের জন্য বাকি বিশ্ব আগ্রহভরে অপেক্ষা করে আসছে। এর সবটাই রাশিয়ার জন্য যথেষ্ট রাজস্ব নিয়ে আসবে।
এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইউক্রেনীয়দের কী করা উচিত, সে বিষয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় পর্ষদ বলে, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও তাঁর দেশের জনগণকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট করতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো কতটা পর্যন্ত সংঘাতে জড়াতে পারবে এবং কতটা অস্ত্র, অর্থ ও রাজনৈতিক সমর্থন দিতে পারবে, সেটা পরিষ্কার করতে হবে। ধ্বংস এড়িয়ে ইউক্রেন যদি টিকে থাকতে চায় তাহলে দেশটির সরকারের জন্য পরিস্থিতির বাস্তব মূল্যায়নের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ মঙ্গলজনক হবে।
ভলোদিমির জেলেনস্কি যদি নিউইয়র্ক টাইমসের এই বাক্যগুলো পড়েন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তিনি ঘামতে শুরু করবেন। তাঁর প্রভুদের কণ্ঠস্বর এখন ভিন্ন। এখন তারা জেলেনস্কি এবং তাঁর দেশের জনগণকে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মুখ রক্ষার জন্য তাদের কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় পর্ষদের মতে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এর ফলে যুদ্ধটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ‘সংঘাতের বর্তমান পর্যায়টি খুব এলোমেলো একটি পর্যায়। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সামনে স্পষ্ট কোনো গোলপোস্ট নেই।’ ‘এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এরই মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক—দুই ক্ষেত্রেই খুব গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। অবাস্তব প্রত্যাশা তাদের আরও গভীর ক্ষতির মুখে ফেলে দেবে।’
‘সাম্প্রতিককালে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু যুদ্ধংদেহী বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, পুতিন (ভ্লাদিমির পুতিন) আর ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, ‘রাশিয়াকে অবশ্যই দুর্বলতর করা হবে।’ হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ‘বিজয় না আসা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইউক্রেনকে সমর্থন করা।’ এসব বক্তব্য ইউক্রেনকে সমর্থন জোগানোর ক্ষেত্রে উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ উত্তেজনা শান্তি আলোচনাকে কাছে ডাকবে না।’
ওয়াশিংটনের নেতাদের যুদ্ধংদেহী বক্তব্যকে ‘উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য’ বলে সেটাকে খারিজ করে দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন। সেটা হলো, যখন নব্যরক্ষণশীলেরা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে যখন নিয়ন্ত্রণ করেন, তখন রাশিয়াকে প্রক্সি যুদ্ধে নিয়ে আসাটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে। সে ক্ষেত্রে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু হয়েছে তেমনটা বলা যাবে না, সব সময়ের জন্যই এটা প্রক্সি যুদ্ধ ছিল।
প্রথম শীতল যুদ্ধ সমাপ্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী পল উলফোভিচ নব্যরক্ষণশীল মতাদর্শকে সূত্রায়িত করেন। সেটি হলো, ‘বৈশ্বিক পরাশক্তি হয়ে উঠতে পারে এমন যেকোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রতিহত করার প্রচেষ্টা আমাদের থাকতে হবে।’ ‘এমনকি আঞ্চলিক অথবা বৈশ্বিক শক্তি হয়ে উঠতে পারে, এমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকেও বাধা দেওয়ার কৌশল আমাদের থাকতে হবে।’
মার্চ থেকে মে—দুই মাসের মধ্যে এমন কী ঘটল, যাতে করে নিউইয়র্ক টাইমস তাদের মতামত বদল করে ফেলল? দশকের পর দশক ধরে নিউইয়র্ক টাইমসের যে অবস্থান, তাতে অবস্থান বদল যে হলো, তার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ আছে বলেই মনে হয়।
সবার আগে যে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে, সেটি হলো, ইউক্রেনে রাশিয়া খুব শোচনীয় পরিস্থিতিতে পড়বে বলে পশ্চিমারা ধারণা করেছিল। তাদের ধারণার থেকে অপ্রত্যাশিত রকম ভালোভাবে পরিস্থিতি সামলাচ্ছে রাশিয়া।
বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১৬৫টি দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরোধিতা করেছে। এ দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও চীনও রয়েছে। দেশ দুটিতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশের বাস। সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর এই অবস্থান বিশ্বে রাশিয়ার চেয়ে বরং যুক্তরাষ্ট্রকে বেশি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মান এখন যুদ্ধ শুরুর আগের থেকে বেশি। গত দুই বছরের মধ্যে এখন রুবল সবচেয়ে শক্তিশালী। মার্চে ডলারের বিপরীতে রুবলের দর যেখানে ১৫০-এ উঠেছিল, এখন সেটা ৫৯-এ নেমেছে। রাশিয়ায় এ বছর ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে। দেশটির গম, সার, তেল ও গ্যাসের জন্য বাকি বিশ্ব আগ্রহভরে অপেক্ষা করে আসছে। এর সবটাই রাশিয়ার জন্য যথেষ্ট রাজস্ব নিয়ে আসবে।
গ্যাসের মূল্য রুবলে পরিশোধে রাশিয়ার দাবির কাছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্রমাগত নতি স্বীকার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য বারবার বলে আসছেন। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে, সেটা পশ্চিমের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেবে।
মাউরিপোল বিজয়ের পর রাশিয়ার সেনারা দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেনে ধীর গতিতে হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে। দীর্ঘ এ যুদ্ধে ইউক্রেনের জন্য নৈতিক পরাজয় অপেক্ষা করছে। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সেখানে এখন ৮ শতাংশের বেশি। নীতি সুদহার বাড়িয়ে ফেডারেল রিজার্ভ সেটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। শেয়ার মার্কেটেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যুদ্ধ যতই প্রলম্বিত হচ্ছে ততই বেশি বেশিসংখ্যক অর্থনীতিবিদ ফেডের সাবেক চেয়ারম্যান বেন বার্নিকির মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করছেন। তাঁর মত হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ বেকারত্ব, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং নিম্ন প্রবৃদ্ধির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।
এসব কারণে যুদ্ধবিরোধিতা যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ছে। ইউক্রেন যুদ্ধে সহযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভায় উত্থাপিত একটি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে নিম্নকক্ষে ৫৭ জন এবং সিনেটে ১১ জন রিপাবলিকান সদস্য ভোট দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধটা ক্রমেই অজনপ্রিয় হয়ে উঠছে। জো বাইডেন ও ডেমোক্রেটিক দলের জন্য ২০২২ ও ২০২৪ সালের ভোটে বিপর্যয়কর ফলাফল অপেক্ষা করছে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
জন ওয়ালশ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস চান মেডিকেল স্কুলের সাইকোলজি ও নিউরোসায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক