মতামত

ইউক্রেন যুদ্ধের যে প্রভাব পড়বে উপমহাদেশে

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের আশঙ্কা নিয়ে বেশ অনেক দিন ধরে জল্পনাকল্পনা ছিল। এ বছরের প্রথম দিকেই রাশিয়া এক লাখের বেশি সৈন্য ইউক্রেনের উত্তর ও পূর্ব সীমানায় মোতায়েন করেছিল। আর যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করেই বলেছিল, রাশিয়া হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সেই হামলা ঠেকাতে কার্যকর কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়নি ইউক্রেন। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) শঙ্কা প্রকাশ করেও ইউক্রেনকে বাঁচানোর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানিসহ কিছু দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তার উদ্যোগ নিচ্ছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে সদস্যদেশগুলোর নিরাপত্তা বাড়াতে সৈন্য পাঠানো হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এ হামলা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটোসহ বিভিন্ন দেশের সহায়তা চেয়েও পাননি। এমন পরিস্থিতিতে জেলেনস্কি তাঁর দেশে সামরিক আইন জারি করে প্রত্যেক সুস্থ ১৮ থেকে ৬০ বছরের নাগরিকদের অস্ত্র হাতে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলেছেন।

অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন জেলেনস্কিকে উৎখাত করে ইউক্রেন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার উদ্দেশ্য বেশ পরিষ্কার। সেখানকার রুশ বংশোদ্ভূতদের রক্ষা বা তাদের অধ্যুষিত এলাকাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আসলে রাশিয়ার মূল উদ্দেশ্য নয়। ইউক্রেন যাতে পশ্চিমের দিকে ঝুঁকতে না পারে এবং ন্যাটোর সদস্য হতে না পারে, তা নিশ্চিত করাই রাশিয়ার লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে ইউক্রেনের সরকার পরিবর্তনই একমাত্র পথ।

স্মরণযোগ্য যে যুক্তরাষ্ট্র মনরো ডকট্রিনের আওতায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৭২টি দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার পরিবর্তন করেছে। বর্তমান সময়ের দৃষ্টান্তের মধ্যে রয়েছে লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের মতো দেশগুলো। তা ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সাবেক সোভিয়েতভুক্ত কিছু নতুন দেশ ও সোভিয়েত প্রভাবিত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে মার্কিন সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এ দেশগুলোর মাধ্যমে ন্যাটো রাশিয়ার ঘাড়ের ওপরে নিশ্বাস ফেলতে পারে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তিকে পুতিন রাশিয়ার জন্য গুরুতর হুমকি মনে করে। তা ছাড়া এককালের জার্মানিতে কেজিবির প্রধান হিসেবে কাজ করা কর্নেল পুতিন ভূরাজনীতি ও কৌশলে যথেষ্ট পারদর্শী। ইউক্রেনে হামলার আগে ভালোভাবেই জেনেছেন যে পশ্চিমা বিশ্ব ইউরোপে যুদ্ধ ছড়াতে রাজি হবে না।

ইউক্রেনে কয়েক বছর আগে অতি দক্ষিণপন্থী মিলিশিয়াদের উত্থানকে রাশিয়া ভালোভাবে নেয়নি। আজব ব্যাটালিয়ন হিসেবে পরিচিত এই মিলিশিয়াদের রাশিয়া ২০১৮ সালে নব্য নাৎসি বলে আখ্যা দেয়। রাশিয়া মনে করে, পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তায় এদের উত্থান হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে পরবর্তী বছরের নির্বাচনে পশ্চিমাপন্থী প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির উত্থান হয়েছে এবং তিনি ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান। স্মরণযোগ্য যে ইউক্রেনের পথ দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার মস্কো, তৎকালীন লেনিনগ্রাদ (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) এবং তৎকালীন স্টালিনগ্রাদ পর্যন্ত অবরোধ করেছিলেন। ইউক্রেন শুধু খনিজেই সমৃদ্ধ নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম কৃষি অঞ্চলও ছিল। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ছাড়া পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার পর সবচেয়ে বড় দেশ হিসেবে ইউক্রেন রাশিয়ার নিরাপত্তারও বড় বিষয়। যে কারণে রাশিয়া এরই মধ্যে ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছে। এখন ইউক্রেনকে ন্যাটো দেশগুলো থেকে দূরে রাখতে এ অভিযান শুরু করেছে।

২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নিলেও পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে ন্যাটো এবং এর পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র তেমন কিছুই করতে পারেনি। রাশিয়ার জন্য ক্রিমিয়া ভূকৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাঁটি, যা প্রায় ন্যাটোর দখলে চলে যাচ্ছিল। অনেকে মনে করেন, তখন পশ্চিমা বিশ্ব কোনো অবস্থান না নেওয়ায় এবং যুক্তরাষ্ট্র নীরব থাকায় রাশিয়ার অবস্থান শক্ত হয়েছে। বিশেষ করে ওই সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সখ্যকে অনেকে দায়ী করছেন এবং মনে করছেন বর্তমান অভিযানের সাহস সেখান থেকেই রাশিয়া পেয়েছে।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ প্রাথমিকভাবে ইউরোপের সংকট হলেও পুরো বিশ্বেই এর অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে এবং বিশ্বরাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হবে। এ সমীকরণ থেকে দক্ষিণ এশিয়া কোনোভাবেই বাদ যাবে না।

রাশিয়ার অভিযান ও আক্রমণে ইউক্রেনের অবশ্যম্ভাবী পতন, কিয়েভে রাশিয়াপন্থী সরকার স্থাপন ও রাশিয়ার উপস্থিতি বিশ্বে শীতল যুদ্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। বিশ্ব এবার দুই শক্তির নয়, ন্যূনপক্ষে ত্রিশক্তির বলয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন। উল্লেখ্য, বর্তমানে চীন-রাশিয়ার সম্পর্কের উষ্ণতার বিষয়টি খুবই পরিষ্কার। ইউক্রেন ইস্যুতে চীন রাশিয়ার পক্ষেই রয়েছে। ইউক্রেনে রুশ হামলার পর হামলা বন্ধে ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটাভুটিতে যে তিনটি দেশ অনুপস্থিত ছিল, তার মধ্যে চীন প্রধান। চীনের সঙ্গে অনুপস্থিত বা ভোট প্রদানে বিরত ছিল ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ প্রাথমিকভাবে ইউরোপের সংকট হলেও পুরো বিশ্বেই এর অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে এবং বিশ্বরাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হবে। এ সমীকরণ থেকে দক্ষিণ এশিয়া কোনোভাবেই বাদ যাবে না। রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকে ইতিমধ্যে সম্পর্কের গভীরতার জানান দিয়েছে ভারত। সামরিক সম্ভার কেনার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সম্প্রতি নতুন করে ঝালাই হয়েছে। ভারত রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক মিসাইল এস-৪০০ ক্রয় করেছে। প্রায় ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সম্ভারের চুক্তি হয়েছে। ইউক্রেন সংকট ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা (সিএএটিএসএ) আরোপ করেছে, তার আওতায় রাশিয়ার এস-৪০০ মিসাইল রয়েছে। এর আগে ন্যাটো সদস্য তুরস্ক একই মিসাইল কেনায় যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি বন্ধ করে দেয়। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্কের কারণে হয়তো তেমন কিছু হবে না।

অপর দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মধ্যে মস্কো সফরে গিয়েছিলেন। আফগানিস্তানে রাশিয়া এবং রুশ ফেডারেশনের সদস্যদের সম্পৃক্ততার কারণে এবং চীনের সঙ্গে উভয় দেশের সম্পর্কের কারণে ইমরান এ সফরে গিয়েছিলেন বলে বিবেচনা করা হয়। এখানে একটি বিষয় অবশ্য বিবেচনায় রাখা উচিত যে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের মতো উষ্ণ নয়। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের প্রেক্ষাপটে যে সংকট তৈরি হবে, তাতে পাকিস্তান যে খুব স্বস্তিতে থাকবে, তেমন নয়।

এদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব গাঢ় না হলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে, যদি আন্তর্জাতিক ব্যাংক লেনদেন রাশিয়ার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যাংক লেনদেনের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি ‘সুইফট’-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলে আপাতত রাশিয়ার তেমন ক্ষতি হয়তো হবে না। কিন্তু বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অর্থনীতিতে চাপ পড়বে। এরই মধ্যে তেলের দাম প্রায় ১০০ ডলার ছড়িয়ে গেছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা করোনা মহামারির কারণে এমনিতেই উপমহাদেশের দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানির দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। আলোচনার মাধ্যমে এ ধরনের বড় সংকট নিশ্চয়ই নিরসন সম্ভব। কিন্তু পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যাবে, তা বলা কঠিন। ইউক্রেনবাসী রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্রের প্রতিশ্রুতি মিলছে। সে ক্ষেত্রে সেখানে যদি গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়, তবে তা শুধু ইউরোপকেই নয়, সমগ্র পৃথিবীকে অস্থির করে তুলবে।

  • ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)। hhintlbd@yahoo.com