ইউক্রেন ইস্যুতে আত্মপরিচয়ের সংকটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন

গত শতাব্দীর দুটি মহাযুদ্ধ থেকে যুদ্ধ যাতনা কাকে বলে তা ইউরোপের জনগণ ভালো করেই জানে। আর আমেরিকা বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধ করলেও যুদ্ধের যে যাতনা এবং নির্মমতা সেই অভিজ্ঞতা নিজ দেশের জনগণের নেই বললেই চলে। ইউরোপের মাটিতে শেষ যুদ্ধ হয়েছ ১৯৯২-১৯৯৪ সালে, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মাটিতে যা বলকান যুদ্ধ বলে পরিচিত। এর পর দীর্ঘ সময় বিশ্বের নানা স্থানে যুদ্ধ হলেও ইউরোপে ঐক্য শান্তির রাজনীতি প্রাধান্য পেয়েছে। ইউরোপ মহাদেশে এই স্থিতিশীল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও ন্যাটো জোটের সম্প্রসারণে মার্কিনিদের উৎসাহের বিষয় নিয়ে ইউরোপে সমালোচনা হচ্ছে। একই ভাবে সমালোচনা হচ্ছে-১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রায় ৩০ বছর পর, রাশিয়া কেন তার প্রাক্তন ভূখণ্ড ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির ওপর প্রভাব বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠছে।

করোনার প্রবল প্রতাপে যখন ইউরোপের জবুথবু অবস্থা, তখন সঙ্গে শুরু হয়েছে নতুন এক উপসর্গ। ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার যুদ্ধ যুদ্ধ হুংকার। করোনা মহামারি কারণে সারা বিশ্ব জুড়েই অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক সংকট। আর এই জরুরি আপত্কালীন সময়ে ইউক্রেনকে নিয়ে ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধের তোড়জোড়, ইউরোপীয় দেশগুলির সরকারগুলোর মাঝে অস্থিরতা বাড়িয়েছে। সম্প্রতি ইউক্রেন ইস্যুতে সামরিক তৎপরতার পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও বেড়েছে পশ্চিমা দেশগুলো।

ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে একই সময়ে জার্মানির নতুন চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ ছুটেছে ওয়াশিংটন আর ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ছুটছে মস্কো। একই সময়ে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক গেছেন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়ভে। এরপর চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ গেছেন কিয়েভ ও মস্কোতে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, যুদ্ধের চেয়ে যুদ্ধের দামামা বা মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করবার প্রবনতাই প্রবল। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন ন্যাটো জোটের পূর্ব ইউরোপে দিকে সম্প্রসারণের সঙ্গে ইউক্রেন সীমান্তে লক্ষাধিক সেনা মোতায়েনকে ন্যায্যতা দিয়েছেন। পাশাপাশি ইউক্রেনের ন্যাটো জোটের সদস্য হওয়ার চেষ্টাকেও তাদের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন।

হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের ইমেরিটাস অধ্যাপক অটো লুচটারহ্যান্ড, দ্য জাইট পত্রিকাটিতে বলেছেন, ‘সামরিক শক্তি ব্যবহারের হুমকি বা রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা ইউক্রেনকে ঘিরে ফেলা, আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।’ অন্যদিকে জার্মানির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োসকার ফিশার সম্প্রতি বলেছেন, ‘রাশিয়া সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় পুরো ইউরোপকে ঘিরে ক্ষমতার বলয় তৈরির চেষ্টা করছে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভূখণ্ডে একটি রাশিয়ান প্রভাবিত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় ব্রত হয়েছেন। ইউক্রেনে সৈন্য সমাবেশ এই পরিকল্পনারই অংশ।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘ ইউরোপীয়রা যদি নিজেদের মধ্যে ঐক্য এবং ট্রান্স আটলান্টিক জোটের সমন্বয় বজায় রাখে তবে দুর্ভবনার কোনো কারণ নেই।’
অনেক দিন থকেই প্রেসিডেন্ট পুতিন বলে আসছেন, ন্যাটো জোটের প্রসারণ করে পশ্চিমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। ২০০৭ সালে জার্মানির মিউনিখ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলনে পুতিন তার বক্তৃতায়, ওয়ারশ সামরিক জোটের পতনের পর পশ্চিমাদের কাছ থেকে ন্যাটো জোট সম্প্রসারণ না হওয়ার আশ্বাসের বিষয়টি বলেছিলেন। পুতিন তার দেশের জন্য নতুন নিরাপত্তা গ্যারান্টি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ও অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের মাঝে মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে যে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা, মূলত তা থেকেই ন্যাটো ও ওয়ারশ জোটের জন্ম। মার্কিনি নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের সঙ্গী হয় পশ্চিম ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলি। আর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো মিলে গঠন করে ওয়ারশ জোট। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন মুছে ফেলে ওয়ারশ জোটকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির এই চুক্তিটি ১৯৫৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। ৩০ বছর আগে ওয়ারশ জোটের বিলুপ্তি ঘটলেও, ন্যাটো জোট দিনে দিনে পূর্ব ইউরোপে তার পরিধি বিস্তৃত করছে। ন্যাটো তার সদস্য সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি করেছে। মোট ৩০ সদস্যভুক্ত এই জোটের অনেক সদস্য রাষ্ট্র এক সময় সোভিয়েত জোটভুক্ত ওয়ারশ জোটের সদস্য ছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময় তার যুদ্ধ নীতির সঙ্গে ইউরোপের বন্ধুদের সহযোগিতা ও সঙ্গী করতে চেয়েছে। বিগত সময়গুলিতে আফগানিস্তান, কুয়েত বা ইরাকের যুদ্ধে যেতে অসম্মতির জন্য ইইউ বা ন্যাটো জোটের বড় সদস্য দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স যুদ্ধবাজ যুক্তরাষ্ট্রের নিকট তিরস্কৃত হয়েছে। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময়, সেই সময়কার মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড, যুদ্ধে যেতে অসম্মতির জন্য কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে ঝাঁজাল সুরে বলেছিলেন, “ফ্রান্স একটা সমস্যা, জার্মানি একটা সমস্যা। ওরা পুরান ইউরোপ। পূর্ব ইউরোপই নতুন ইউরোপ।
এরপরও ন্যাটো জোটের পরিধি বিস্তার এবং বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধে যাওয়ার মার্কিনি যুদ্ধবাজ নীতি এবং অস্ত্র নির্ভর অর্থনীতির বিষয়টিতে ইউরোপের সরকারগুলি ভালো চোখে দেখে না। ব্যতিক্রম হলো পোল্যান্ড বা হাঙ্গেরি বা রোমানিয়ার মতো রক্ষণশীল সরকার বা বাল্টিক অঞ্চলের তিন দেশ লাটভিয়া, এস্তোনিয়া ও লিথুনিয়া। এখন ইউক্রেনও ন্যাটো জোটের সদস্য হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় দেশ জার্মানি কেন ইউক্রেন ইস্যুতে ততটা সরব নয় বা রাশিয়ার বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করছে না, তা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। জার্মানির জন্য গলার কাঁটার মতো বিঁধে আছে রাশিয়া-জার্মানি গ্যাস পাইপ লাইন বা নর্থস্ট্রিম ২ নামক প্রকল্প। ইউক্রেনে সংকটে জার্মানির জন্য যুক্ত হয়েছে গ্যাস রাজনীতি। দুটি বিশ্বযুদ্ধের চরম বীভৎসতা আর বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় নেতারা যতটা সম্ভব নিজ ভূখণ্ডে যুদ্ধকে এড়িয়ে চলার কৌশল গ্রহণ করেছে।

মার্কিনি যুদ্ধনীতি থেকে বেরিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্বার্থে জোটের দুই বড় দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স ইইউ জোটের আত্মপরিচয় সংকট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। তারা মহাদেশীয় শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হতে চাইলেও, ভূ-রাজনীতি তাতে বাঁধা সাঁধেছে।

সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
Sharaf.ahmed@gmx.net