ইউক্রেনে মানবিক বিপর্যয়ের দায় কি পশ্চিম এড়াতে পারে

রাশিয়ার হামলায় বিধ্বস্ত ইউক্রেনের ইরপিন শহর
 ছবি: এএফপি

সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালাল রাশিয়া। ভ্লাদিমির পুতিনের এ পদক্ষেপ ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা এবং ইউরোপের শান্তি পদদলিত করেছে। ইউক্রেনের এ মানবিক বিপর্যয় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, ভূরাজনীতি আসলে রাষ্ট্রীয় নৈরাজ্য, যেখানে সবলদের শিকার হয় দুর্বলেরা। প্রাথমিকভাবে এ যুদ্ধের কারণ হচ্ছে সামরিক হঠকারিতা এবং একজন শীতলমাথার স্বৈরশাসকের নিজেকে ভুক্তভোগী ভাবার মানসিকতা। রুশ সমাজের গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে না পারার ব্যর্থতাও আরেকটা কারণ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা কি এ ট্র্যাজেডির দায় এড়াতে পারে? জর্জ কেনান (যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সোভিয়েত মোকাবিলার নীতি প্রণয়নকারী) থেকে শুরু করে হেনরি কিসিঞ্জার—যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তববাদী নীতিনির্ধারকেরা বলে আসছেন, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার ‘প্রভাববলয়’কে স্বীকার করে নিতে হবে।

২০০৮ সালে বুখারেস্ট সম্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়ার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেছিলেন। সে সময় কিসিঞ্জার যুক্তি দিয়েছিলেন দেশ দুটিকে ন্যাটোর সঙ্গে যুক্ত না করে নিরপেক্ষ রাখতে হবে। তাঁর উদ্বেগের বিষয় ছিল পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর এ সম্প্রসারণ রাশিয়ার কাছে আঞ্চলিক স্থিতাবস্থা বদলে দেওয়ার সংকেত হিসেবে দেখা দিতে পারে। এ বছরের ১৯ জানুয়ারি মার্কিন ফরেন পলিসি জার্নালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন ওয়াল্ট এক নিবন্ধে পূর্বানুমান করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের আগ্রাসী মূল্যবোধভিত্তিক বিদেশনীতি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন চালাতে প্ররোচিত করবে। তাঁর সেই পূর্বানুমান ঠিকই সত্যে পরিণত হলো। ওয়াল্ট বলেন, ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণের প্রশ্নটির সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। এই বিশেষজ্ঞের মতে, এটা ধারণা করা মোটেই কঠিন নয় যে এ ধরনের পদক্ষেপকে রাশিয়া নিজেদের একঘরে করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখবে। এটিকে তাঁর শাসনের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে পুতিন শেষমেশ কঠোর সামরিক পদক্ষেপ নেবেন।

ফাঁপা আবেগ সরিয়ে দিলে রূঢ় সত্যটাও বেরিয়ে পড়ে। জেলেনস্কি সংকট নিরসন করতে এবং যুদ্ধ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরস্পরবিরোধী বার্তা দিয়ে, সমর্থকদের সামনে ন্যাটোর সদস্যপদের মুলো ঝুলিয়ে, রাশিয়ার সঙ্গে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং পশ্চিমের কাছ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র চেয়ে—জেলেনস্কি সমস্যাটাকে আরও জটিল করে তুলেছেন।

ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে একটু তাকানো যাক। পরাশক্তির ‘বিভক্ত করো ও জয় করো’ কৌশলের বড় দৃষ্টান্ত ইউক্রেন। ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয় ইউক্রেন। সে সময় থেকে ইউক্রেনে দুটি ভিন্নধর্মী জাতিসত্তার মানুষেরা পারস্পরিক সহাবস্থান করত। ইউক্রেনের পশ্চিম দিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্যাথলিকেরা। তাঁরা ইউক্রেনীয় ভাষায় কথা বলেন ও নিজেদের ইউরোপীয় পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। পূর্ব দিকে সংখ্যাগুরু অর্থোডক্স খ্রিষ্টানরা। তঁারা রুশভাষী ও নিজেদের স্লাভিক জাতিসত্তার মানুষ বলে পরিচয় দেন।

এ দুই ভিন্ন জাতিসত্তার সংঘাত ও বিভাজন বিদেশি শক্তির আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। বর্তমান বিপর্যয়টি ২০১৪ সালের সংকটের ধারাবাহিকতা। সে সময় ইউরোপের সঙ্গে আত্মিক সংযোগ খুঁজে পাওয়া ইউক্রেনীয়রা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়াকুনোভিচকে উচ্ছেদ করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় মস্কো। চলমান আগ্রাসনের পেছনেও একই ধরনের ঘটনা রয়েছে। ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার শর্ত হিসেবে ইউক্রেন সরকার দনবাস অঞ্চল থেকে রুশ-সমর্থিত বিদ্রোহীদের হটিয়ে দিতে জোর প্রচেষ্টা শুরু করে। এর ফলে বিদ্রোহীদের রক্ষা করার অজুহাত থেকে রাশিয়া সেনা অভিযানের মতো কট্টর পদক্ষেপ নেয় রাশিয়া। দনবাসের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক নামের রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদী শাসিত দুই অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয় মস্কো।

এখন প্রশ্ন হলো, খড়ের গাদায় আগুন দিল কে? সেটা অবশ্যই নেতাদের ভুল হিসাবের ফসল। আমি শুধু পুতিনের আগ্রাসন শুরুর মতো বালখিল্য সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বলছি না, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ভুল সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও বলছি। ২০১৯ সালে শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যোদ্ধা হিসেবে জেলেনস্কি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর জেলেনস্কির সমর্থন দেশে ও বিদেশে ব্যাপক বেড়ে গেছে। রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর দেশের জনগণ ও সেনাবাহিনী যে প্রতিরোধযুদ্ধ করছে, সেটার সমর্থনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে তাঁর অবস্থান দৃঢ় হয়েছে।

কিন্তু ফাঁপা আবেগ সরিয়ে দিলে রূঢ় সত্যটাও বেরিয়ে পড়ে। জেলেনস্কি সংকট নিরসন করতে এবং যুদ্ধ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরস্পরবিরোধী বার্তা দিয়ে, সমর্থকদের সামনে ন্যাটোর সদস্যপদের মুলো ঝুলিয়ে, রাশিয়ার সঙ্গে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং পশ্চিমের কাছ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র চেয়ে—জেলেনস্কি সমস্যাটাকে আরও জটিল করে তুলেছেন। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন নিয়ে অনেকে অনেক ধারণা পোষণ করতে পারেন। কিন্তু রাশিয়ার প্রভাববলয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা নিয়ে যদি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা আরও বিচক্ষণ হতো, যদি ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ঐক্যবদ্ধ হতো এবং সংকট ব্যবস্থাপনায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পারদর্শী হতেন, তাহলে ইউক্রেন ট্র্যাজেডি এড়ানো যেত।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া

  • মুন ছাং-ইন উত্তর কোরিয়াবিষয়ক দক্ষিণ কোরীয় সরকারের উপদেষ্টা