দিনে দুপুরে একজন মানুষকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করল, আর চারপাশের সব মানুষ সেই দৃশ্য দেখল, কেউ ছবি তুলে সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেন; কিন্তু আক্রান্ত মানুষটিকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন না, এ কেমন সমাজে আমরা বাস করছি?
দেশে আইনের শাসন এতটাই ভঙ্গুর যে দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে মানুষ খুন করতে সাহস পায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে প্রথম আলোর বরগুনা প্রতিনিধি মোহাম্মদ রফিক জানান, ‘রিফাত শরীফ গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকাকে বরগুনা সরকারি কলেজে নিয়ে যান। কলেজ থেকে ফেরার পথে মূল ফটকে নয়ন, রিফাত ফরাজীসহ আরও দুই যুবক রিফাত শরীফের ওপর হামলা চালান। এ সময় তাঁরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই হামলাকারীদের থামানো যায়নি। তাঁরা রিফাত শরীফকে উপর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে চলে যান। পরে স্থানীয় লোকজন রিফাত শরীফকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে রিফাত শরীফের মৃত্যু হয়। ওই হামলার ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।’
বৃহস্পতিবার নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকার সংবাদ সম্মেলনের বক্তৃতা যারা শুনেছেন, ইউটিউবে দেখেছেন, তাঁদের পক্ষে কান্না ধরে রাখা কঠিন। কলেজপড়ুয়া একটি মেয়ে স্বামীকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এ রকম পরিস্থিতির শিকার হলেন, অথচ কেউ আক্রান্তকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন না। সবাই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকলেন! আমাদের সমাজ এতটা নিষ্ঠুর ও বিবেকহীন হলো কীভাবে?
আয়েশা সিদ্দিকা আরও জানিয়েছেন, ‘আমার সামনেই সন্ত্রাসীরা আমার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমি শত চেষ্টা করেও তাঁকে রক্ষা করতে পারিনি। হামলার সময় কোনো লোক এগিয়ে আসেনি। নয়ন, রিশান ফরাজী ও রিফাত ফরাজী এই হামলা চালিয়েছে।’
এই লজ্জা আয়েশা সিদ্দিকার নয়। এ লজ্জা আমাদের সবার—এই সমাজের ও রাষ্ট্রের। কেননা তারা একজন নারীকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। দুর্বৃত্তদের জিঘাংসা থেকে একজন নিরীহ মানুষকে রক্ষা করতে পারেননি। যে দেশে বড় বড় অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যায়, সে দেশেই দুর্বৃত্তরা এভাবে প্রকাশ্যে কুপিয়ে মানুষ হত্যার সাহস পায়।
সেদিন আয়েশার সঙ্গে অন্তত আরেক তরুণ দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করকে চেয়েছিলেন। তার নাম নুরুল ইসলাম রনি। কিন্তু খুনিরা ছিল ভয়ংকর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা যায়, খুনি নয়ন ও তার সহযোগীরা রাম দা দিয়ে রিফাতকে কোপাচ্ছেন। আয়েশা সিদ্দিকা রাম দাধারীর হাত ধরে নিবৃত্ত করতে চাইছেন। কিন্তু খুনিদের উন্মত্ততা ও নৃশংসতার কাছে তাঁকে হার মানতে হয়েছে।
রিফাত শরীফকে হত্যার ঘটনা আমাদের আরেকটি খুনের দৃশ্য মনে করিয়ে দেয়। ঢাকায় বিশ্বজিৎ নামে এক তরুণকেও এভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগের কর্মীরা। সেটি ছিল রাজনৈতিক ঘটনা। বিরোধী দলের হরতাল বন্ধ করতে ছাত্রলীগের বীরপুরুষেরা দরজি দোকানের এক দরিদ্র কর্মচারীর ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শুধু রিফাত ও বিশ্বজিৎই নৃশংসতার শিকার নন। ফেনীতে মাদ্রাসার অধ্যক্ষরূপী দুর্বৃত্ত কীভাবে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, সে ঘটনা দেশবাসী দেখেছে। নরসিংদীতেও আরেক নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। প্রতিদিনই দশের কোথাও না কোথাও নারী ও শিশুরা নৃশংসতার শিকার হচ্ছে। আর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কঠোর নির্দেশে দিয়ে যাচ্ছেন, অপরাধীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। কিন্তু তারপরও অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন।
বুধবার রাতে রিফাতের হত্যার ঘটনায় তাঁর বাবা ১২ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত পাঁচ থেকে ছয়জনকে আসামি করে বরগুনা সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ তিনজনকে আটক কলেও প্রধান আসামি নয়ন ধরা পড়েনি। সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে এসে বরিশাল বিভাগের পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শফিকুল ইসলাম বলেন, হামলার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ যদি সত্যি সত্যি অপরাধীদের আইনের আওতায় আনত তাহলে নয়নেরা এত দুর্ধর্ষ হতে পারত না। তার আগেই তাদের শাস্তি হতো।
আয়েশা সিদ্দিকা বলেছেন, অনেক দিন ধরেই নয়ন তাঁকে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন। তিনি প্রথমে পরিবারকে না জানালেও পরে জানিয়েছেন। স্বামী এর প্রতিবাদ করেছেন বলেই তাঁর ওপর হামলা হয়েছে। তাহলে কি সমাজে সাধারণ মানুষ, নিরীহ মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে না। অন্যায় প্রতিবাদ করলেই খুন হতে হবে? আয়েশা সিদ্দিকার অভিযোগ, নয়ন বিভিন্ন সময় আমাকে বিরক্ত করত, এসব ঘটনা পরিবারকে না জানাতে আমাকে হুমকি দিত। স্বামী তার প্রতিবাদ করায় ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে হত্যা করেছেন।
বৃহস্পতিবার বরগুনা প্রতিনিধির সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়। তিনি জানান, নয়ন বন্ড নামের ছেলেটি দলবল নিয়ে রিফাতকে হত্যা করছে, সে মাদকব্যবসায়ী। নিজেও মাদকসেবী। তার বিরুদ্ধে থানায় আটটি মামলা আছে। কিন্তু মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণাকারী পুলিশ বাহিনী তাকে ধরেনি। ধরলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে এসে ফের মাদক ব্যবসা করছে।
ময়নাতদন্তে রিপোর্ট অনুযায়ী, নিহত রিফাত শরীফের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ আঘাতের চিহ্ন ও রক্তক্ষরণ শুধু রিফাতের শরীরে নয়। এই সমাজের শরীরের অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নিয়ত রক্তক্ষরণ ঘটছে। কিন্তু আমাদের সমাজের ও রাষ্ট্রের যারা নিয়ন্ত্রক তারা নির্বিকার। তাদের ভাবসাবে মনে হয়, যেন কিছুই হয়নি।
রিফাত শরীফের হত্যার বিষয়ে একজন আইনজীবী বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মাননীয় আদালত মন্তব্য করেন, ‘সারা দেশেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সমাজটা কোথায় যাচ্ছে। প্রকাশ্য রাস্তায় মানুষটাকে মারল। একজন ছাড়া কেউ এগিয়ে আসল না। জনগণকে আপনি কী করবেন? বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন ছিল না। ভিডিও করল, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসল না। এটি জনগণের ব্যর্থতা। তাই এই সামাজিক সচেতনতা তৈরি করবে কে? দাঁড়িয়ে দেখেছে, কেউ প্রতিবাদ করল না। পাঁচজন মানুষ অন্তত এগিয়ে আসলে হয়তো তারা সাহস পেত না। হয়তো তারা (দুর্বৃত্তরা) ক্ষমতাবান, হয়তো মানুষ ভয়ে এগিয়ে আসেনি।’
বাংলাদেশে এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? এভাবে প্রকাশ্যে কুপিয়ে মানুষ মারার পর কেন প্রতিবাদের কণ্ঠ জোরালো হয় না? আদালত আসলে ক্ষমতাহীন মানুষের মনের কথা বলেছেন। কিন্তু ক্ষমতার আসনে যারা বসে আসছেন, তাদের নীরবতা কবে ভাঙবে?
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক
আরও পড়ুন:
এই রামদা কে দিয়েছে?