গত দুটি নির্বাচন কমিশনের, বিশেষত নূরুল হুদা কমিশনের নগ্ন পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে (আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং আমাদের ভোটাধিকার হরণ করেছে) নবগঠিত কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন চরম আস্থার সংকটের সম্মুখীন। বিরাজমান আস্থার সংকট উত্তরণে আউয়াল কমিশনের মোটাদাগে তিনটি করণীয় রয়েছে। প্রথমত, নিজেদের কিছু প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, কমিশনের নিজের ঘর গোছানো। তৃতীয়ত, বিদ্যমান বিধিবিধানের কঠোর প্রয়োগ।
নবগঠিত আউয়াল কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হতে পারে গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ। এর লক্ষ্য হবে বিদ্যমান বিধিবিধান প্রয়োগে এবং সবার জন্য সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে গত দুটি নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা ও অপারগতাগুলো চিহ্নিত করা, যাতে ভবিষ্যতে এগুলোর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এমন একটি বিশ্লেষণ থেকে আরও বেরিয়ে আসবে এ দুটি ব্যর্থ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্যান্য অংশীজনের, বিশেষত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের-ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলো।
আমাদের সংবিধানের ১২৫(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘কোনো আদালত, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হইয়াছে এইরূপ কোনো নির্বাচনের বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসংগত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ প্রদান না করিয়া, অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনো আদেশ বা নির্দেশ প্রদান করিবেন না।’ সংবিধানের এ নির্দেশনার ব্যত্যয়সহ গত নির্বাচনের সময়ে আমাদের উচ্চ আদালতের ভূমিকারও একটি পর্যালোচনা হওয়া আবশ্যক। প্রসঙ্গত, বহুলাংশে উচ্চ আদালতের সহায়তার কারণেই ভারতের কিংবদন্তিতুল্য সিইসি টিএন সেশন সফল হয়েছিলেন।
অতীতে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে অনেকগুলো সংলাপ করেছে। এসব সংলাপের কার্যবিবরণী ও প্রতিবেদনের পর্যালোচনা করাও কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ হতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের সচিবালয় এবং কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে কমিশনের অভ্যন্তরে দলবাজি ও দুর্নীতির একটি সিন্ডিকেটও গড়ে ওঠার। এসবের বিহিত হওয়া আবশ্যক।
নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে জড়িত কমিশনের অনেক কর্মকর্তা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও)-এর অধ্যায় ৬-এ উল্লেখিত নানা ধরনের শাস্তিযোগ্য নির্বাচনী অপরাধে জড়িত হয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। একই সঙ্গে জরুরি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু রিটার্নিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনভঙ্গের যে অভিযোগ উঠেছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। আরও খতিয়ে দেখা দরকার, সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও বেআইনিভাবে অনেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের বৈধতা প্রদানের অভিযোগ।
বিশেষজ্ঞ কমিটির সভাপতি প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরীর পরামর্শ অগ্রাহ্য করে অতি চড়া মূল্যে নিম্নমানের ইভিএম কেনা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া এটি ব্যবহারের মাধ্যমে ‘ডিজিটাল জালিয়াতি’ করা হয়েছে, বিশেষত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। এর তদন্ত প্রয়োজন। কিছু নির্বাচনী অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি হবে না।
গত দুটি নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার কারণে ভোটার তালিকায় গুরুতর ত্রুটি দেখা দিয়েছে, যার ফলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার তালিকায় পুরুষের তুলনায় ১৪ লাখের বেশি নারী থাকলেও বর্তমানে ভোটার তালিকায় পুরুষের সংখ্যা বেশি। কোনো কোনো জেলায় এ ‘জেন্ডার গ্যাপে’র পরিমাণ ব্যাপক। ভোটার তালিকার এ ত্রুটি দূর করতে কমিশনকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
যদিও সংলাপ এবং আলাপ-আলোচনাই একমাত্র সমাধানের পথ, তবু কমিশনের সংলাপের উদ্যোগ একটু বেশি আগে হয়ে গেছে বলে আমাদের ধারণা। নির্বাচন কমিশন ওপরে উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো নিয়ে কয়েক মাস কাজ করার পর সংলাপের আয়োজন করলে তা আরও সফল হতো বলে আমাদের বিশ্বাস
সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত আইন থাকলেও এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগ হয় না। যেমন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য আরপিওর ৯০ ধারায় অনেকগুলো শর্ত রয়েছে। ৯০খ(১) (খ) (ই) ধারা অনুযায়ী, ‘নিবন্ধনে আগ্রহী রাজনৈতিক দলের দলীয় গঠনতন্ত্রে নিম্নরূপ সুস্পষ্ট বিধান থাকিতে হইবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা ছাত্র এবং আর্থিক, বাণিজ্যিক বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বা সংস্থার কর্মচারী বা শ্রমিকদের সমন্বয়ে বা অন্য কোনো পেশার সদস্যদের সমন্বয়ে সহযোগী বা অঙ্গসংগঠন না থাকা।’ কিন্তু আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিধান বাদ দিলেও, ক্ষুদ্র স্বার্থে তথাকথিত ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বলে এগুলো অব্যাহত রেখেছে, যা আরপিওর অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
এ ছাড়া আরপিওর ৯০গ (১) (ঙ) ধারা অনুযায়ী, ‘কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের অযোগ্য হইবে, যদি...উহার গঠনতন্ত্রে দেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে কোনো অফিস, শাখা বা কমিটি গঠন ও পরিচালনার বিধান থাকে।’ এ ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলো অন্যায় ও অনৈতিকভাবে তাদের বিদেশি শাখা অব্যাহত রেখেছে, যা প্রতিনিয়ত দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত করছে।
আরপিওর ১২(৩খ) ধারা অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীকে আট তথ্যসংবলিত একটি হলফনামা দাখিল করতে হয়। এই হলফনামা প্রদানের উদ্দেশ্য নির্বাচনে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা উৎসাহিত করা। কিন্তু বিদ্যমান হলফনামার ছকটি যুগোপযোগী নয়। সর্বোপরি হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য কমিশনের পক্ষ থেকে কোনোরূপ যাচাই-বাছাই করা হয় না, যা করা হলে অনেক অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকে আমাদের নির্বাচনী অঙ্গন থেকে দূরে রাখা সম্ভব হতো। তাই অনতিবিলম্বে কমিশনের পক্ষ থেকে হলফনামার ছকটি যুগোপযোগী করার এবং হলফনামাগুলো যাচাই-বাছাই করার উদ্যোগ নেওয়া আবশ্যক। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র অনলাইনে দাখিল করার বিধান বাধ্যতামূলক করা, ‘বিরুদ্ধ হলফনামা’ প্রদানের বিধানকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া এবং বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষক রাখার ব্যবস্থা করাও অত্যন্ত জরুরি।
পরিশেষে যদিও সংলাপ এবং আলাপ-আলোচনাই একমাত্র সমাধানের পথ, তবু কমিশনের সংলাপের উদ্যোগ একটু বেশি আগে হয়ে গেছে বলে আমাদের ধারণা। নির্বাচন কমিশন ওপরে উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো নিয়ে কয়েক মাস কাজ করার পর সংলাপের আয়োজন করলে তা আরও সফল হতো বলে আমাদের বিশ্বাস।
● ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক