ঈদ মানে শৈশবের স্মৃতি। আমাদের রংপুর পিটিআইয়ের ধূলিধূসরিত প্রাঙ্গণ ঢাকা থাকত চোরকাঁটায়। হাফপ্যান্ট পরে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলে ফিরে আসার পর প্যান্ট ভরে থাকত চোরকাঁটার দানা কিংবা কাঁটা। আমরা বলতাম ওকড়া। বৃষ্টির দিনে মাঠে পানি জমত, পুকুর থেকে, কিংবা শ্যামাসুন্দরী খাল থেকে উজিয়ে উঠত ডানকিনে মাছ। কৃষ্ণচূড়ার ডাল ভেঙে পড়ত সামান্য বাতাসে। আর সেই বৃষ্টিভাসা মাঠে চলত আমাদের কর্দমাক্ত ফুটবল। কিন্তু ঈদের বিকেলে? অবধারিত ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। পাড়ার ছেলেরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গাছের ডাল কেটে বানানো ব্যাট, উইকেট এবং টেনিস বল দিয়ে চলত ক্রিকেট। আজ বহুদিন পর ঈদ এবং ক্রিকেট এক হয়ে গেছে আমাদের জন্য।
যেবার বাংলাদেশে বিশ্বকাপের আসর বসেছিল, সেবার লিখেছিলাম, আসুন আমরা দর্শক হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৫৮ রানে বাংলাদেশ অলআউট হয়ে যাওয়ার পরে মেরুনজার্সিদের বাসে পড়ল ঢিল, আর ক্রিস গেইল টুইটারে সেই তথ্য জানিয়ে দিলেন দুনিয়াময়। খুব লজ্জা পেয়েছিলাম আমরা। তারপর আমাদের এই একটা বিশেষ প্রচারই ছিল মুখ্য, ক্রিকেটে কে জিতবে, তা আমাদের হাতে নেই। আমাদের হাতে যা আছে তা হলো আমরা নিজেরা সুন্দর হতে পারি, ভালো হতে পারি, চ্যাম্পিয়ন হতে পারি। আমরা মানে বাংলাদেশের মানুষেরা।
এবার ম্যাককালামের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে যখন বাংলাদেশ হারিয়ে দিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে, আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম: প্রিয় ম্যাককালাম, আপনি কি দয়া করে আপনার কথা গিলে ফেলবেন? একটু পরে সেই স্ট্যাটাসের নিচে কমেন্টসের ঘরে দেখলাম গালিগালাজ, আর যিনি করেছেন, তিনি একজন আবৃত্তিশিল্পী, সুভাষিণী। দ্রুতই আমার স্ট্যাটাস মুছে দিলাম, কারণ ক্রিকেট জাতীয়তাবাদ আমাদের অন্ধ করে ফেলে, কখনো কখনো আমাদের পরিমিতিবোধ কাজ করে না। সামনে আরও অন্তত আটটা খেলা। পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা খেলব, ভারতের সঙ্গে খেলব, আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলব। সেই সব দিনে কি আমরা আরও অপরিশীলিত কথাবার্তা বলব? আমি বলি কী, তর্কে জিতে কী লাভ? বলবেন, ওরা আমাদের নিয়ে ট্রল করে কেন? আমরা কেন ছেড়ে দেব? দিন না ছেড়ে। আমরা দর্শক হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হই। তাহলে আমাদের টিম-বাংলাদেশও চ্যাম্পিয়ন হবে। খেলা কিন্তু দেশে দেশে মানুষে মানুষে মৈত্রী স্থাপনের জন্যই।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে একটা চমৎকার কথা আছে, ‘তুমি অধম–তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন।’
নবকুমার কাঠের সন্ধানে বনে গেল। তাকে ফেলে রেখেই নৌকা ছেড়ে দিল। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘যাত্রীরা নবকুমার ব্যতীত স্বদেশে গমনই উচিত বিবেচনা করিলেন। নবকুমার সেই ভীষণ সমুদ্রতীরে বনবাসে বিসর্জত হইলেন।’
‘ইহা শুনিয়া যদি কেহ প্রতিজ্ঞা করেন, কখনও পরের উপবাস নিবারণর্থ কাষ্ঠাহরণে যাইবেন না, তবে তিনি উপহাসাস্পদ। আত্মোপকারীকে বনবাসে বিসর্জন করা তাহাদিগের প্রকৃতি, তাহারা চিরকাল আত্মোপকারীকে বনবাস দিবে-কিন্তু যত বার বনবাসিত করুক না কেন, পরের কাষ্ঠাহরণ করা যাহার স্বভাব, সে পুনর্বার পরের কাষ্ঠাহরণে যাইবে। তুমি অধম-তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?’
অন্যেরা অধম হতে পারে, তাদের কথা ভুল হতে পারে, আচরণ পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট হতে পারে, আমাদের টিম আম্পায়ারিংয়ে ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হতে পারে, কিন্তু আমাদের আচরণ হতে হবে খেলোয়াড়সুলভ। খেলোয়াড়সুলভ কথাটাই তো কত সুন্দর। খেলোয়াড়ি মনোভাব মানেই জয়-পরাজয়কে হাসিমুখে মেনে নিতে শেখা। মেনে নিতে পারা।
এবারের বিশ্বকাপে আমাদের আশা বড়। ২০১৮ সালে অক্টোবরে আমি সাকিব আল হাসানের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম প্রথম আলোর জন্য। তিনি বলেছিলেন, ‘ইংল্যান্ডের কন্ডিশন কিন্তু আমাদের জন্য কঠিন। তবু স্বপ্ন দেখতে হবে।’ সাকিব বলেন, ‘স্বপ্ন মানে যা সম্ভব তা ভাবা নয়।’ মানে তিনি বুঝিয়েছিলেন, আপনি ভাবলেন আপনি প্লেনে চড়েছেন, এটা স্বপ্ন নয়। আপনার দুটো পাখা গজিয়েছে, এটা হলো স্বপ্ন। স্বপ্ন তা–ই, যা শুনলে অন্যেরা আপনাকে পাগল বলবে।
বিশ্বকাপ নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখছি। আমাদের এই স্বপ্নের কথা কেবল আমরা জানি, অন্যরা জানে না। অন্যরা শুনলে বলবে, অসম্ভব। আমরা বলব, তাই তো এটা স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন কত দূর সফল হবে, তা আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জানা যাবে। কিন্তু দর্শক হিসেবে, ক্রিকেটভক্ত জাতি হিসেবে আমাদের চ্যাম্পিয়নশিপ আমাদের হাতে। আমরা দর্শক হিসেবে পরিণত হয়েছি কি না, এটা প্রমাণ দেবার দায়িত্ব আপনার–আমার সবার। এবং সেটার প্রমাণ আমাদের দিতে হবে ফেসবুকে, টুইটারে, ইনস্টাগ্রামে! আসুন, আলো ছড়াই। আসুন, সুন্দরভাবে কথা বলি। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদও যেন সুন্দর হয়, সূর্যোদয়ের মতো সুন্দর।
আনিসুল হক: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো