চামড়া পাতলা থাকলে অনেক সমস্যা। একটু কিছুতেই গায়ে ফোসকা পড়ে। মোটা হলে সুবিধা প্রচুর। হাজার প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সুস্থির থাকা যায়, মেনে নেওয়া যায় লাখো অসংগতি। যেহেতু পাতলা চামড়ায় পড়া ফোসকার প্রতিকারে আমরা অক্ষম, তাই চামড়া মোটা করাতে মনোনিবেশ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। অন্তত একটা অজুহাত তো পাওয়া যাবে!
ডান হাত, বাম হাতের চেয়ে ঢের কার্যকর, কিন্তু অজুহাত। এই ‘হাত’ তুলনাহীন। হয়তো রাস্তায় কোনো ছিনতাই ঘটতে দেখলেন বা কাউকে অহেতুক হেনস্তা হতে দেখলেন, চামড়া মোটা থাকলে আপনি চাইলেই সেসব পরিস্থিতি অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় এড়িয়ে যেতে পারবেন। একটু দাঁড়িয়ে দেখে ‘চিকনে’ কেটে পড়তে পারবেন। কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করলে, সরাসরি বলে দিতে পারবেন, ‘আমার চামড়া মোটা, গায়ে লাগবে না খোঁটা।’ এই প্রক্রিয়াতে আমরা নানা অপমান সয়ে যাওয়ার তরিকাও খুঁজতে পারি।
অপমান নানা কিসিমের হয়। কিছু কিছু অপমান হয় সুইয়ের মতো। মনে ঢুকে পড়ে সহজেই। এরপর দিনকে দিন খুঁচিয়েই যায়। তাতে যাতনা প্রচণ্ড। ঠিক যেমনটা যশোরের মনিরামপুরে ঘটেছে। দুজন বয়স্ক ব্যক্তিকে কানে ধরানো হলো। তাঁদের দিকে ক্যামেরা তাক করা হলো। সেই ক্যামেরা চালু করলেন আবার ওই এলাকার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান। ‘তৎকালীন’ বলতে হচ্ছে, কারণ তাঁকে এরই মধ্যে ওই ঘটনার জন্য দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নতুন করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমানে আমাদের দেশে কিছুটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। কিন্তু যাঁদের ঘরে ভাত নেই, তাঁরা ঘরে থাকার উপদেশ মানবেন কীভাবে? ফলে পেটের তাগিদেই জরুরি পরিষেবার অংশ না হয়েও কাউকে কাউকে বের হতে হচ্ছে। হ্যাঁ, সরকার সবাইকে ঘরে থাকতে বলছে। কিন্তু ক্ষুধা পেটে নিয়ে আর কতক্ষণ ঘরে থাকা যায়? তাই বের হতেই হচ্ছে কাউকে কাউকে। অসচেতনতা হেতু সেই চলাফেরা বর্তমান পরিস্থিতিতে আদর্শ হচ্ছে না। আর তাতেই গোল পাকছে। কিন্তু এর প্রতিকার কী ভদ্রভাবে বুঝিয়ে বলাতে হয় না? আদালতের রায় ছাড়া এভাবে কী কোনো নাগরিককে ‘শিক্ষা’ দেওয়া যায়? হ্যাঁ যায়, যদি ক্ষমতার মাত্রা চূড়ান্ত হয়। তবে কী স্বেচ্ছাচারের দেশে আছি?
আরও বিষয় আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিত্তের দিক থেকে নিম্নবর্গের মানুষদের রক্ষার ক্ষেত্রে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং তাতে কেমন ফল হয়েছে, সেটিও বিস্তারিত জানানো দরকার নাগরিকদের। জরুরি পরিস্থিতিতে আগলে রাখবে—তার জন্যই তো সরকার।
আচ্ছা, দোষী ব্যক্তিকে না হয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু ওই দুই নাগরিকের ‘অপমান’ কীভাবে মুছবে? সেই ইরেজার কি প্রশাসনের হাতে আছে? কোনো একদিন যদি কানে ধরার কথা মনে করে ওই দুজনের মুখ অপমানে নীল হয়ে যায়, তখন?
আরে ধুর, ওসব ভাবার সময় আছে নাকি! আমরা এটিও বলতে পারি যে—গায়ের চামড়া মোটা করে নিতে পারলে, আর কিছুই মনে পড়বে না। সুতরাং, আসুন গাত্রচর্মকে পরিপুষ্ট করি, এর ঘনত্ব বাড়াই। কে জানে, নতুন করোনাভাইরাসও এতে ভয় পেতে পারে!
ভাইরাসের চোখ-কান থাকলে আসলে ভয়ই পেত। বগুড়ার শিবগঞ্জে একজন ব্যক্তিকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন না। গত শুক্রবার রাতে ওই ব্যক্তির অবস্থার অবনতি হয়। অসুস্থ স্বামীকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য স্ত্রী পাড়া-প্রতিবেশীদের সহযোগিতা চান। ওই ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে কেউ এগিয়ে আসেননি। এরপর স্ত্রী অ্যাম্বুলেন্সের জন্য মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন জেলা ও উপজেলার হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশে। কিন্তু কেউ কোনো সাড়া দেয়নি। সারা রাত এভাবেই কাটে। শনিবার দুপুরে জানা যায়, ওই ব্যক্তি মারা গেছেন। আশপাশের সবাই মিলে লোকটাকে মরতে দিল। খুব জানতে ইচ্ছা করছে, একজনকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দিয়ে বাকি সবার কেমন লাগছে? স্বস্তি পাচ্ছেন?
একটি বিষয় বুঝতে পারছি। ভাইরাস সংক্রমণের মতোই গণহারে এ দেশের সবার চামড়া মোটা হতে শুরু করেছে। জীবন বাঁচানোর কোনো আকুতিই তাতে আঁচড় কাটতে পারছে না। সমস্যা হলো—নতুন করোনাভাইরাস মানুষ-অমানুষনির্বিশেষে সবাইকেই ধরে। সে ক্ষেত্রে মানুষ থাকলেই ভালো হতো না কি?
অবশ্য চামড়া মোটা হতে হতে যদি গন্ডারকেও ছাড়িয়ে যায়, তবে একটি সম্ভাবনা উঁকি দেয়। বেশি মোটা হলে ওই চামড়া যদি ডেঙ্গু ও এডিস মশাকে ফাঁকি দিতে পারে! এটি হলে কিন্তু খারাপ হয় না। প্রথম আলোর খবরে প্রকাশ, গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রথম তিন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় চার গুণ। বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস নিয়ে হই-হট্টগোলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মনোযোগ কম। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ বেগবান করতে গিয়ে গতি কমছে মশার ওষুধ ছিটানো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের। আর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গু মৌসুমে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা গত বছরকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। সিংহের থাবা থেকে বাঁচতে গিয়ে না আবার বাঘের খপ্পরে পড়তে হয়!
তার চেয়ে বরং আসুন, চামড়া মোটা করি। বুঝতেই তো পারছেন, চামড়া মোটা থাকার কত্ত সুবিধা। স্কুলজীবনে কৃষিশিক্ষা বিষয় নিয়ে পড়তে গিয়ে গরু মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ার কথা জেনেছিলাম। ইশ, সেভাবে যদি গায়ের চামড়া মোটা করতে পারতাম! কী ভালোই না হতো।
অর্ণব সান্যাল: লেখক ও সাংবাদিক
arnab.sanyal@prothomalo.com