আসিয়া বিবি নামে খ্যাত আসিয়া নরেন পাকিস্তানের একজন দরিদ্র শ্রমজীবী নারী। তাঁর স্বামী ইটভাটার শ্রমিক। ধর্মে খ্রিষ্টান। আসিয়া বিবির বয়স ৪৭। ২০০৯ সালে মাঠে কাজ করার সময় প্রতিবেশী কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা–কাটাকাটি হয়। তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে ইসলাম ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে অবমাননার অভিযোগ আনেন। মামলার বিচার করে ২০১০ সালে পাঞ্জাবের শেখুপুরার জেলা আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন তাঁকে। সে থেকেই কারাগারে। ২০১৪ সালে লাহোর হাইকোর্ট খারিজ করে দেন তাঁর আপিল। বহাল থাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ। এত সব আইনি ঝামেলা করার সামর্থ্য তাঁর পরিবারের নেই। তবে দেশ–বিদেশের কিছু মানবাধিকার সংগঠন আইনি সহায়তায় সমর্থন দিতে থাকে। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড না দিতে অন্য অনেকের মতো ষোড়শ পোপ বেনেডিক্ট এবং বর্তমান পোপ ফ্রান্সিসও অনুরোধ করেন। অবশেষে ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণের অসংগতি বিবেচনায় নিয়ে বেকসুর খালাস দেন তাঁকে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এ আদেশের পরও প্রভাবশালী একটি মহল দেশব্যাপী জোরদার আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনকারীদের একজন নেতা ৫ লাখ রুপি পুরস্কারও ঘোষণা দেন আসিয়া বিবিকে হত্যার জন্য। কেউ কেউ এই রায় দানকারী বিচারকদেরও হত্যা করা উচিত বলে মন্তব্য করতে থাকেন। তাঁর আইনজীবী সাইফুল মুলুক প্রাণভয়ে দেশ ছাড়েন। আতঙ্কে স্থানান্তরে লুকিয়ে থাকেন তাঁর স্বামী ও পাঁচ সন্তান। দেশের সর্বোচ্চ আদালত অভিযোগের দায় থেকে মুক্তি দিলেও কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে ছাড়তে পারছিল না। বরং সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একটি অনৈতিক চুক্তি করতে বাধ্য হয়। চুক্তিটি হচ্ছে, আন্দোলনকারীরা সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ আবেদন করবে। তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে দেশ ছাড়তে দেওয়া হবে না।
উল্লেখ্য, সে আন্দোলনকারীদের একটি বড় অংশ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নির্বাচনী জোটের অংশীদার। চুক্তিটি হয়তো কৌশলগত কারণে করা হয়েছে। তবে এর খেসারতও সরকারকে দিতে হবে। দেশ–বিদেশের সচেতন মানুষের চাপে তাঁকে পাঞ্জাবের মুলতান কারাগার থেকে গোপনে মুক্তি
দিয়ে অজ্ঞাত স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। সরকার বিষয়টি কোনো অবস্থাতেই
স্বীকার করছে না। অবস্থা যা–ই হোক, আসিয়া বিবি মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে জেল খাটলেন আট বছর। আমাদের দেশেও নিকট অতীতে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামির পক্ষে সহিংস আন্দোলন দেখেছি। তবে সেগুলো সরকার দমন করেছে কঠোর হাতে।
অন্যদিকে পাকিস্তান সরকারকে নিতে হলো একটি অনৈতিক সমঝোতার দায়। সেনাশাসক জিয়াউল হকের সময়েই এর সুদূরপ্রসারী বহুমাত্রিক বিকাশ ঘটে। পাকিস্তান একটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র। সেখানে সাম্প্রদায়িক শক্তি বরাবরই জোরদার। ধর্মকে রাজনীতির ঢাল হিসেবেও করা হয় ব্যবহার। প্রকৃত আলেম–ওলামারা এর অংশীদার নন বলেই জানা যায়। উল্লেখ করতে হয়, অন্য ধর্ম অবমাননার জন্য এত কঠোর শাস্তির বিধান আগে কখনো ছিল না। দণ্ডবিধিতে সংশোধনী এনে এটা মৃত্যুদণ্ডজনিত শাস্তির কাতারে আনা হয়। সে দেশটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা খুবই কম। যারা আছে, তারা ভোগে নিরাপত্তাহীনতায়। আকৃতি আর প্রকৃতিভেদে এ পরিস্থিতি উপমহাদেশে সর্বত্র। আমরাও মুক্ত নই। তবে পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের বিরোধিতা করায় আততায়ীর হাতে নিহত হন সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী শাহবাজ ভাট্টি। এ আইনের বিরোধিতার কারণেই নিজ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির।
ভারতের জাতির জনক নিহত হয়েছিলেন ধর্মান্ধদের হাতে। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হয়েছিলেন ধর্মান্ধ শিখ দেহরক্ষীর দ্বারা। তাঁরা তাঁকে পবিত্র স্থান স্বর্ণমন্দির অভিযানের মাধ্যমে অপবিত্র করার দায় দেন। সে অভিযানের নির্দেশ অবশ্যই তিনি দিয়েছিলেন। আর সেটা ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য। এখানে শক্তি প্রয়োগের মাত্রা সম্পর্কে বিতর্কও থাকতে পারে।
তবে কোনো কারণেই এ ধরনের হত্যা সমর্থনযোগ্য নয়। তেমনি এ ঘটনার পরপর দুই দিনে বহুসংখ্যক নিরপরাধ শিখের প্রাণসংহারও সমর্থন করা চলে না। সবই ধর্মীয় উন্মাদনা। অথচ নেতৃত্ব দেননি কোনো ধর্মীয় নেতা। তবে পাকিস্তানে এ ধর্মান্ধতা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জোরালো ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তারা আইন, আদালত, সরকার কিছুই মানতে চায় না। তেমনি একটি দুর্ভাগ্যজনক বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে ভারতের কেরালা রাজ্যের শবরিমালা মন্দিরকে নিয়ে।
এ মন্দিরগুলো হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র বলে বিবেচিত। বার্ষিক সমাবেশে দুই থেকে তিন কোটি লোকের সমাগম হয়। সারা বছর দর্শন করে পাঁচ কোটি লোক। দ্বাদশ শতকে নির্মিত এসব মন্দির। যুগবাহিত রেওয়াজ অনুসারে এখানে ১০–ঊর্ধ্ব থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে যুগ পাল্টায়। পাল্টাতে হয় নিয়মও। অনেক দিন থেকেই এ বয়সের নারীরা মন্দিরে ভক্তি দেওয়ার সুযোগের দাবি করছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ অনড়। এ নিয়ে ১৯৯১ সালে কেরালা হাইকোর্টের একটি মামলায়ও মন্দির কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই বহাল থাকে। শেষাবধি ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ–জাতীয় নিষেধাজ্ঞাকে অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক বলে উল্লেখ করেন। বেআইনি ঘোষণা করেন এ নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু আদেশ কার্যকর হয়নি আজও। মানতে নারাজ পরিবর্তনবিরোধীরা। সরকার আদালতের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে এখনো সফল হয়নি। এটি ভাবতে অবাক লাগে, এ রাজ্যটি ১৯৭০ সাল থেকে কংগ্রেস কিংবা বামফ্রন্টের শাসনে আছে। এ সংগঠনগুলো মৌলবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়। প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করে নিজেদের। আসলে ভোটের রাজনীতি এ অক্ষমতার জন্য দায়ী। একটি বিশেষ বয়সের নারীরা মন্দিরগুলোতে অচ্ছুত থাকবেন? মানা হবে না দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ? আশা করব, সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ভুলবে না।
আমরাও কম যাই না। সাম্প্রতিক কালেই রামুর ধ্বংসযজ্ঞ দীর্ঘদিন স্মরণে থাকবে। একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে এ ধ্বংসযজ্ঞে অংশগ্রহণকারীরা সর্বদলীয় ছিল বলেই ব্যাপকভাবে খবরে এসেছে। নেতৃত্ব দেননি কিংবা অংশগ্রহণ করেননি কোনো আলেম–ওলামা। অপরাধীদের কারও বিচার হয়নি অদ্যাবধি। এ আকৃতি-প্রকৃতির না হলেও নাসিরনগরসহ কোনো কোনো স্থানে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে। দেশান্তরে গেছেন কেউ কেউ। ধর্ম অবমাননা করে কেউ কাগজে কিংবা ফেসবুকে লিখলে বিষয়টি আমরা আইনের হাতে ছেড়ে দিতে পারি। পৃথিবী এখন ছোট একটি গ্রাম। যেকোনো ঘটনা মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের ভাবমূর্তি।
কথা হতে পারে, প্রতিবেশী দেশেও ধর্মান্ধতা জোরদার হচ্ছে। অবশ্যই এটা অনুচিত। গো–রক্ষার নামে পিটিয়ে মানুষ হত্যাসহ বেশ কিছু অমানবিক বিষয় আমাদের বিচলিত করে। ক্ষুব্ধ করে সীমান্তে বিএসএফের ‘ট্রিগার হ্যাপি’ কার্যকলাপ। অনেক স্থানের নাম পরিবর্তনের হিড়িক চলছে। এগুলো অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। আর তাই বলে আমরা অন্যের মন্দ কাজকে অনুকরণ করব কেন? আমাদের দেশে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাদের জীবনাচারে ইসলামের ভাবধারার প্রভাব থাকবে, এটা স্বাভাবিক। পৃথিবীর অন্য কোথাও মুসলমানরা নির্যাতিত বা মুসলিম সংস্কৃতিকে হেয়
করা হলে তারা ব্যথিত হওয়ার কথা। আর তা নিরসনের জন্য হিংসাত্মক পথকে আমরা বেছে নিতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে দেশের আলেম–ওলামাদের বিশাল অংশ এসব পথের পক্ষে নন। সাম্প্রদায়িক সংঘাতে তাঁদের ভূমিকা লক্ষণীয় হয় না। তাঁরা এ ধরনের প্ররোচনাও দেন না। অবশ্য ইসলামবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁরা করেন সভা–সমাবেশ। মিছিলও করেন। আর এগুলো শান্তিপূর্ণ থাকলে তা করতেই পারেন।
এত কথার পেছনে থাকছে উপমহাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের একটি শক্ত অবস্থান নিয়ে। এটা ক্ষতিকারক, তা সবাইকে বুঝতে হবে। টুইন টাওয়ার ধ্বংস পৃথিবীর মুসলমানদের কত ক্ষতি করেছে, তা যেকোনো বিচক্ষণ লোক বুঝতে পারেন। ধর্মান্ধতা পাকিস্তানকে সব দিক দিয়ে পিছিয়ে ফেলছে। ভারত আজন্মলালিত ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনায় হালে গ্লানি লেপন করছে। এগুলো তাদের মর্যাদা বাড়াবে না। হবে না কোনো বৈষয়িক লাভ। রাজনৈতিক লাভের জন্য এগুলো করা হলেও একসময় ক্ষতিরই কারণ হয়।
আলী ইমাম মজুমদার : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali1950@gmail.com