মতামত

আশা-ভরসার অভাবই বাংলাদেশের বড় অভাব

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সমবায় নীতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘দেশে টাকার অভাব আছে বলিলে সবটা বলা হয় না। আসল কথা, আমাদের দেশে ভরসার অভাব।’ সত্যিকারভাবেই আজ আমাদের দেশে আশা-ভরসার যেন আকাল পড়েছে। এই আকাল সর্বব্যাপী। এটি দৃশ্যমান সর্বত্র এবং সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের একটি জেলার চায়ের দোকানে কিছুক্ষণের জন্য আড্ডা দেওয়ার সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজমান হতাশা-নিরাশার ব্যাপকতার সঙ্গে আমার পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়। এ আড্ডায় খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে অটোচালক, শিক্ষক, সাবেক ও বর্তমান স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও অংশ নিয়েছিলেন। গণমাধ্যমের সুবাদে তাঁদের মধ্যে অনেকেই আমাকে চিনতে পেরেছেন এবং মন খুলে কথা বলেছেন।

আমাদের কথা শুরু হয় নির্বাচন কমিশন ও কমিশনে নিয়োগ নিয়ে। উপস্থিত প্রায় সবাই গত দুটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। ২০১৮ সালে সকালে ভোট দিতে গেলে তাঁদের বলা হয়েছে তাঁদের ভোট হয়ে গেছে। কেউ কেউ ভোট দেওয়ার দাবি করে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। আর ভোট দিতে না পারার কারণে তাঁরা চরমভাবে ক্ষুব্ধ এবং এর জন্য তাঁরা দায়ী করেছেন বিদায়ী হুদা কমিশনকে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যিনি প্রথমবার ভোটার হিসেবে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে না পারলেও ভিন্ন জেলায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরে দারুণভাবে উৎফুল্ল। আড্ডায় অংশগ্রহণকারীদের মতামত থেকে এটি সুস্পষ্ট যে বাংলাদেশের মানুষ এখনো ভোটপাগল এবং ভোট দেওয়ার অধিকার তাঁদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আড্ডায় উপস্থিত কয়েকজন বলেন, নির্বাচন কমিশন চাইলেও ভালো নির্বাচন করতে পারবে না, কারণ তাদের হাতে ‘বাহিনী’ নেই। বাহিনী যার হাতে সে-ই নির্বাচনে জেতে। এতে ভোটের দরকার হয় না। কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তাঁদের খারাপ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তাঁদের এলাকায় এমপি সাহেব সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এমপি আগে থেকেই নির্দেশ দিয়েছেন, কাকে কাকে জেতাতে হবে, আর তাঁরাই জিতেছেন। সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আড্ডায় উপস্থিত দুজন বলেছেন, তাঁদের জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের কাছে এ ব্যাপারে নালিশ করলে তাঁরা তাঁদের অসহায়ত্ব ব্যক্ত করেন।

আড্ডায় অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাই এক সুরে নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেন। তাঁদের মতে, সরকার সবখানেই নিজের লোক বসিয়ে রেখেছে। এদের রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই তাঁরা ভবিষ্যতে সুন্দর নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখেন না। তাঁদের অনেকের মতে, ভোটের সময় পুলিশ দিয়ে হবে না, সেনাবাহিনী লাগবে।

ইভিএম নিয়ে আড্ডায় অংশগ্রহণকারীদের ক্ষোভও ব্যাপক। ইভিএম অনেক খেটে খাওয়া মানুষকে চিহ্নিত করতে পারে না, কারণ তাঁদের হাতের রেখা ক্ষয় হয়ে যায়। তাঁদের মতে, পেপার ব্যালটে ভোট হলে কী হয়, তা তাঁরা দেখতে পান। কিন্তু ইভিএমে কী হয়, কিছুই বুঝতে পারেন না। তাঁরা নিশ্চিত হতে পারেন না, যে প্রার্থীকে তাঁরা ভোট দিয়েছেন, সেই প্রার্থী আসলে ভোট পাবেন কি না। তাঁদের মতে, আগে নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া হতো, সহিংসতা হতো, কেন্দ্র দখলের চেষ্টা হতো, কিন্তু এখন অদৃশ্যভাবে সব কারচুপি করা যায়। তাই তাঁরা আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রবল বিপক্ষে।

আমাদের এ আড্ডাকালে কয়েকজন বলার চেষ্টা করেন, দেশে বর্তমানে যা হচ্ছে, তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে যাঁরা আছেন, তাঁরা দায়ী। কিন্তু তাঁদের অপকর্মের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর কাঁধে এসে পড়েছে। তাঁরা আরও বলেন, ‘অপেক্ষা করুন, বঙ্গবন্ধুকন্যা সব ঠিক করে ফেলবেন।’ অন্য কয়েকজন উচ্চকণ্ঠে বলার চেষ্টা করেন, যাঁরা অন্যায় করছেন, তাঁদের তো প্রধানমন্ত্রীই নিয়োগ দিয়েছেন। দুর্নীতি ও অপকর্ম করার জন্য তিনি তাঁদের বরখাস্ত করেন না কেন? তাঁদের কেউ কেউ স্থানীয় পর্যায়ের পাতিনেতাদের বাড়াবাড়িতে সাধারণ মানুষ চরম ক্ষুব্ধ বলে মত প্রকাশ করেন। তাঁরা অতিষ্ঠ সরকারের উচ্চ পদে আসীন কিছু ব্যক্তির লাগামহীন অতিকথনে।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবকিছু নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক অনাস্থা বিরাজ করছে। তাঁরা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন আমাদের রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানের ওপর। রাজনীতিবিদদের সম্পর্কেও তাঁরা হতাশ, যদিও বর্তমান গ্যাঁড়াকল থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে তাঁরা দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ওপর ভরসা রাখতে চান।

আড্ডায় উপস্থিত বেশ কয়েকজন বিএনপির নেতৃত্ব নিয়েও জোরালো প্রশ্ন তোলেন। তাঁরা জানতে চান, বিএনপির নেতা কে? খালেদা জিয়া? না তারেক রহমান? তাঁরা বলার চেষ্টা করেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ, তা ভুয়া। তাঁরা তাঁর মুক্তি চান এবং তাঁকে বিএনপির নেতৃত্বে দেখতে চান।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন ছাত্র বলেন, তাঁদের হলে দুটি মাত্র সংগঠন আছে, যার একটি হলো ছাত্রলীগ, আরেকটি তাবলিগ জামায়াত, যদিও তাবলিগ কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। ছাত্রলীগ অন্য কোনো সংগঠনকে থাকতে দেয় না। ভিন্নমতাবলম্বী অনেকে টিকে থাকার খাতিরে ছাত্রলীগে যোগ দেন। আর ছাত্রলীগে যোগ দিলে তাঁরা চাকরি থেকে শুরু করে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান। কয়েকজন ছাত্রের অভিমত থেকে এটি সুস্পষ্ট যে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সামনে দুটিমাত্র বিকল্প—হয় ছাত্রলীগ, না হয় একটি ধর্মাশ্রয়ী সংগঠন।

উত্তরবঙ্গের একটি জেলার চায়ের দোকানে তৃণমূলের একদল মানুষের সঙ্গে ঘণ্টা দুই কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকে আমার মধ্যে কতগুলো উপলব্ধি সৃষ্টি হয়েছে। একটি উপলব্ধি হলো যে দেশের বর্তমান পরিস্থিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজমান। তৃণমূলের এসব মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় অসন্তোষ ভোট দিতে না পারার কারণে তাঁরা তাঁদের ভোটের অধিকারকে অনেক বড় করে দেখেন।

আমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি হলো, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবকিছু নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক অনাস্থা বিরাজ করছে। তাঁরা আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন আমাদের রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানের ওপর। রাজনীতিবিদদের সম্পর্কেও তাঁরা হতাশ, যদিও বর্তমান গ্যাঁড়াকল থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে তাঁরা দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ওপর ভরসা রাখতে চান। সেনাবাহিনীর ওপর তাঁরা এখনো পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলেননি।

এই যে ব্যাপক হতাশা-নিরাশার মনোভাব, তার পরিণতি দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। ইতিমধ্যে এরই প্রতিফলন দেখছি আমাদের তরুণদের মধ্যে, যাঁরা বিশেষত মেধাবী। তরুণেরা আজ বিদেশে পাড়ি দিতে এক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে, যা জাতির ভবিষ্যতের জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। এর চেয়ে আরও ভয়াবহ হলো যে তরুণদের কেউ কেউ ধর্মভিত্তিক সমাধানের দিকে এগোচ্ছেন। ফলে সরকারের কঠোরতার কারণে উগ্রপন্থীদের প্রকাশ্য তৎপরতা তেমন দেখা না গেলেও, ধর্মান্ধ শক্তি ভেতরে-ভেতরে ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে বলেই অনেকের ধারণা।

উত্তরবঙ্গের এ আড্ডায় যে হতাশা-নিরাশা এবং হাল ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা আমি লক্ষ করেছি, তা আমাকে পোল্যান্ডের কবি ব্রুনো জেসিয়েনস্কির একটি বিখ্যাত কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়, ‘তোমরা শত্রুকে ভয় করো না। বড়জোর তারা তোমাকে হত্যা করবে। তোমার বন্ধুকে ভয় করো না। তারা বড়জোর তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। ভয় করো তাদের, যারা হাল ছেড়ে দিয়েছে; তারা তোমাকে হত্যাও করবে না বা তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও করবে না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা ও হত্যা টিকে আছে তাদের নীরব সম্মতির কারণে।’ অতএব, সাধু সাবধান!

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)