মতামত

আশা নিয়েই শুরু হোক নতুন বছর

আমাজনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আইএমডিবি ২০২১-এর বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক টিভি শো তৈরি করেছে, নাম দিয়েছে ‘ডেথ টু ২০২১’, বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘২০২১ নিপাত যাক’। ফিরে তাকালে বছরটিতে ভালো কিছু প্রায় নজরে পড়ে না। চীনে শুরু যে কোভিড মহামারি ২০২০ সালে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছিল, ২০২১ সালেও তার প্রাণঘাতী অগ্রযাত্রা অব্যাহত ছিল। বরাবরের মতোই বিশ্বনেতারা একজোট হয়ে এই বৈশ্বিক সমস্যাকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

বছরের শুরুটা হয়েছিল একটা অবিশ্বাস্য অঘটন দিয়ে। ২০২০–এর নির্বাচনে পরাজিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান, ঠিক তৃতীয় বিশ্বের নেতাদের মতো। ৬ জানুয়ারি যখন মার্কিন ক্যাপিটলে প্রতিনিধি ভোট গণনার আনুষ্ঠানিকতা চলছিল, তখন ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্ররোচনায় তাঁর এক দল সমর্থক সেখানে লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ চালান। গণনা বানচাল বা ভাইস প্রেসিডেন্টকে হত্যার উদ্দেশ্য তাঁদের সফল হয়নি। তবে মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য এই আঘাত কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়েই থাকবে।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং প্রায় বিনা বাধায় তালেবানের কাবুল দখল ছিল বছরের আরেকটি যুগান্তকারী ঘটনা। ক্ষমতা হারানোর পরবর্তী ২০ বছরে তালেবানের নীতিমালা নমনীয় হয়নি একটুও। বিশেষ করে, নারী প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান আগের মতোই কট্টর রয়ে গেছে। দেশটিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে, তবে সেটা নিয়ে তালেবান সরকার খুব বিচলিত বলে মনে হচ্ছে না। এ সরকারকে এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি কোনো দেশ। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও আটকে আছে যুক্তরাষ্ট্রে।

ইউরোপে দীর্ঘ ১৬ বছরের আঙ্গেলা ম্যার্কেল যুগের অবসান হয়েছে জার্মানিতে। সর্বশেষ মধ্য-ডান সরকারে তাঁর জোটসঙ্গী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বে নতুন মধ্য-বাম কোয়ালিশন দায়িত্ব নিয়েছে ৮ ডিসেম্বর। চ্যান্সেলর হয়েছেন ওলাফ শলৎজ, বিদায়ী ম্যার্কেল সরকারে যিনি ছিলেন অর্থমন্ত্রী। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পপুলিস্ট ডানপন্থী উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশটিতে এই পরিবর্তন তাৎপর্যবহ ঘটনা।

বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের দিকে তাকানো যাক এবার। বাংলাদেশ–ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে একটি সুসংবাদ আছে ২০২১ সালে। ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রথমবারের মতো এক বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ২০২১-২২ অর্থবছরের এ অঙ্ক দুই বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর বাইরে দুই দেশের সম্পর্কে অবশ্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই। তিস্তা বা আর কোনো নদীর পানিবণ্টন অগ্রগতি নেই। কঠিন ও ক্ষেত্রবিশেষে অবাস্তব শর্তের কারণে ভারতের দেওয়া ক্রেডিট লাইনের অর্থ ছাড়ের গতি ধীর রয়ে গেছে আগের মতোই। বিএসএফের গুলিতে সীমান্তে যথারীতি অসামরিক বাংলাদেশিরা প্রাণ হারাচ্ছেন।

প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে ভারতের হাইকমিশনার এ নিয়ে বেশ কিছু পরিসংখ্যানও দিয়েছেন। এ তথ্য কতটা বস্তুনিষ্ঠ তা অবশ্য বিবেচনার দাবি রাখে। আমি চার বছর কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলাম। কলকাতার কোনো পত্রিকায় ‘বাংলাদেশি চোরাচালানিদের সঙ্গে সংঘর্ষে বিএসএফ জওয়ান নিহত’ এরূপ কোনো শিরোনাম কখনো দেখিনি। সমস্যা হচ্ছে চলমান ভারতীয় সংস্কৃতিতে গরুর জীবনের মূল্য মানুষের জীবনের চেয়ে বেশি। তাই গরু চোরাচালান ঠেকাতে মানুষের দিকে প্রাণঘাতী অস্ত্র চালাতে বাধা নেই। প্রতিবছর ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল নামক মাদক চোরাচালান হয়ে আসে বাংলাদেশে। কোনো ফেনসিডিল চালানকারী বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন বলে শুনিনি কখনো।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ২০২১ সালটি ভালো যায়নি। ২০২০–এর ১৪ অক্টোবর মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইন্দো–প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এই চীনবিরোধী জোটে যোগ দেওয়া সংগত কারণেই বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ এরূপ জোটবদ্ধতা বাংলাদেশের নিরপেক্ষতার নীতির পরিপন্থী। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ অর্থায়নের সর্ববৃহৎ উৎসও হচ্ছে চীন। আর চীন এটা বেশ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে এ জোটে যোগ দিলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

২০২১ সালের শেষ দিকে এসে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যেগুলোকে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে ৯-১০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে গণতন্ত্র শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমন্ত্রিত ১১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল না। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ র‍্যাব এবং র‍্যাবের সঙ্গে বর্তমানে বা অতীতে সংশ্লিষ্ট সাতজন কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র, যার মাঝে র‍্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক এবং পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক রয়েছেন। এরপর বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে প্রদত্ত মার্কিন সহায়তা কীভাবে ব্যয় করা হয়েছে, তার হিসাব চায় যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া একজন সাবেক সেনাপ্রধানের মার্কিন ভিসা বাতিল করা হয়েছে। বাংলাদেশি ছাত্রদের জন্য ফুল ব্রাইট বৃত্তিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চীনবিরোধী মার্কিন প্রকল্পে যোগ দিতে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই এসব করা হয়েছে বলে প্রচলিত বিশ্বাস। তবে এতে মার্কিন অর্জন কী হবে, তা খুব বোধগম্য নয়।

২০২১–এর দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কেও টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছিল বেশ। চিহ্নিত অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত নিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছিল বাংলাদেশ, কিন্তু তা বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা অবলম্বন করছিল। এ নিয়ে অসন্তুষ্ট ইইউ বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানে কিছু অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপের পদক্ষেপ নিচ্ছিল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সচিব পর্যায়ের কনসালটেশনে এর একটা বিহিত হয়েছে। মানবাধিকার, বিশেষত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সম্ভাব্য অপব্যবহার নিয়ে ইইউ তার উদ্বেগ ব্যক্ত করেছে। এই কনসালটেশনকে রাজনৈতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণের একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটিকে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি বলা যায়। বাণিজ্য, বিনিয়োগের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইউরোপের সঙ্গে প্রতিরক্ষা, ভূরাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে সহযোগিতার দিগন্তও উন্মুক্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি এ বছরে। চীনের মধ্যস্থতায় যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা শুরু হয়েছিল ২০২০–এর শেষে, তা–ও থমকে আছে মিয়ানমারে কিছু অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহের কারণে। প্রথম ঘটনা, ১ ফেব্রুয়ারি অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন আধা সামরিক সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনীর আবার ক্ষমতা দখল। মিয়ানমারে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে এর বিরুদ্ধে, যা কঠোর হাতে দমন করছে সেনাবাহিনী। সহস্রাধিক বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে এতে। দ্বিতীয় ঘটনা, সেনাবাহিনী কর্তৃক বাতিলকৃত সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা এনএলডির নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে যে ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের সরকার ৩ জুন ২০২১ তারিখের এক অবস্থানপত্রে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, অধিকার ও সম্মানের সঙ্গে স্বদেশ প্রত্যাবাসনের অঙ্গীকার করেছে এবং তাদের সামরিক সরকারবিরোধী সংগ্রামে শরিক হতে আহ্বান জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের এই স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনো ভবিষ্যৎ সমাধানে তা ভূমিকা রাখতে পারে।

২০২১ সালে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অনেকটা অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। মাদক ও মানব পাচার, হত্যাকাণ্ডসহ বিবিধ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সেখানে, যার সঙ্গে স্থানীয় অপরাধীদেরও যোগসাজশ আছে। এদের অনেকে মিয়ানমার সেনাদের পক্ষে কাজ করছে, এমন অভিযোগও আছে। প্রত্যাবাসনপন্থী গুরুত্বপূর্ণ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ এদের হাতে নিহত হন। ক্যাম্পগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য।

সারা পৃথিবীর জন্য যেমন, বাংলাদেশের জন্যও ২০২১ ছিল একটি কঠিন বছর। এর মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো করেছে তুলনামূলকভাবে। করোনা পরিস্থতিও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। প্রত্যাশা থাকবে ২০২২ সালে মহামারির করালগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসবে পৃথিবী, সেই সঙ্গে বাংলাদেশ। মানুষের চলাচল, জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সুস্থ, স্বাভাবিক হয়ে আসবে আবার। আন্তর্জাতিক পরিসরে যা কিছু বৈরী পরিবেশের সম্মুখীন বাংলাদেশ, আসছে বছরে সেসবের সমাধানের সূত্র মিলবে, এই আশা নিয়েই শুরু হোক নতুন বছর।

  • মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব