মতামত

আল-কায়েদা আর জঙ্গিদের তাণ্ডবলীলার ওপর রঙের পলেস্তারা

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভ। রমজান কাদিরভ কোনো অবস্থাতেই পরমত সহিষ্ণু নেতা নন। তবে তাঁকে নরপিশাচ বলে কোনো অবস্থাতেই আখ্যায়িত করা যায় না।
ছবি: রয়টার্স

চেচনিয়ার নেতা রমজান কাদিরভের ওপর দীর্ঘ একটি কলাম প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। হঠাৎ করে চেচনিয়ার এই নেতার প্রতি কলাম লেখক কেন এতটা বিষোদ্‌গার তা বুঝে ওঠা না গেলেও পশ্চিমের সুরে তিনি যে সেখানে গান গেয়ে গেছেন, সেই প্রমাণ স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে সেই রচনায়। কলাম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভ্লাদিমির পুতিনকে এক জঘন্য ধরনের স্বৈরাচার হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, যিনি কিনা চেচনিয়ায় রক্ত-গঙ্গা বইয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই ভূখণ্ডকে আবারও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে রমজান কাদিরভ নামের এক নর-রাক্ষসকে সেখানে ক্ষমতায় বসিয়েছেন, হত্যা আর দমন-পীড়ন ছাড়া অন্য কোনো ভাবনা যার চিন্তায় একেবারেই নেই।

তবে কোন পরিপ্রেক্ষিতে চেচনিয়ার ক্ষমতার মঞ্চে কাদিরভের আবির্ভাব, সেই প্রেক্ষাপট কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হলেও দূর ইতিহাসের অগোছালো কিছু উদ্ধৃতি টেনে এনে যা বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা হলো, রুশরা জারিনা একাতেরিনা ভেলিকায়ার আমল থেকে চেচেনদের স্বাধীন অস্তিত্বের টুটি চেপে ধরে খুন-খারাপি আর হত্যার রাজনীতি সেখানে সমানে চালিয়ে গেছে। তবে কথা হচ্ছে, বাস্তবতা এ রকম অবশ্যই দাবি করে থাকে যে, সেই অঞ্চল জুড়ে গত ৩০০ বছরে কী ঘটেছিল তা বুঝে ওঠার জন্য রাশিয়ার ইতিহাসের সুলুক সন্ধান হচ্ছে কেবল অংশবিশেষ, ঘটনার সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট তা কোনো অবস্থাতেই নয়।

চেচেন নেতা জোখার দুদায়েভের স্বাধীনতা ঘোষণাকে রাশিয়া দেখেছিল রাষ্ট্রদ্রোহমূলক তৎপরতা হিসেবে।

ককেশাস পর্বতমালার যে অঞ্চলজুড়ে চেচেনদের বসবাস, সেই এলাকাটি দূর অতীতকাল থেকেই বিভিন্ন জাতিসত্তার একটি মোজাইক হিসেবে পরিচিত। চেচেনদের পাশাপাশি সেখানে আছে ইঙ্গুশ, আভার, বৈকার, লাখ, কাবার্দিন, আবখাজ এবং আরও কিছু ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, যাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দূর অতীতে বাণিজ্যের পশার ঘটাতে আসা ভ্রাম্যমাণ আরব বণিকদের কল্যাণে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিলেও একই সঙ্গে সেখানে আছে সনাতন খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের বাস। ফলে জাতিগত প্রশ্নটি হচ্ছে অঞ্চল জুড়ে খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়। পাশাপাশি সেই অঞ্চলের সীমানা ঘেঁষে মধ্য যুগ থেকেই ছিল শক্তিশালী দুটি সাম্রাজ্যের অবস্থান এবং পশ্চিমে আরও কিছু দূরে ছিল তৃতীয় আরেক বলিষ্ঠ সাম্রাজ্য।

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই, তবে যা সহজেই আমাদের নজরে পড়বে তা হলো, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য নিজস্ব স্বাধীন অস্তিত্ব ধরে রাখা সেই যুগে ছিল প্রায় অসম্ভব। ফলে ককেশাস অঞ্চলের ক্ষুদ্র সেই সব জাতিকেও শক্তিশালী তিন সাম্রাজ্য-রাশিয়া, ওসমানিয়া তুরস্ক এবং হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের মধ্যে অনেকটা যেন দাবার ঘুঁটির চাল চেলে অস্তিত্ব বজায় রাখার খেলায় জড়িত হতে হয়।

সেই খেলায় এসব জাতিসত্তার অংশবিশেষ কখনো চলে আসে তুরস্কের প্রভাব বলয়ে, কখনো আবার রাশিয়ার। স্বাধীন অস্তিত্ব এদের সেই অর্থে কখনো ছিল না। চেচেন নেতা ইমাম শামিল কিংবা হাজি মুরাত-যাদের কথাই আমরা আলোচনায় নিয়ে আসি না কেন, এদেরকেও খেলে যেতে হয়েছে সেই একই খেলা, যার সূত্র ধরে নিজেদের জীবনের ওপর দেখা দেওয়া হুমকিও নেতারা এড়িয়ে যেতে পারেননি। পাঠকদের মনে থাকার কথা হাজি মুরাত উপন্যাসের শেষ দিকে অসহায় সেই স্থানীয় নেতার ছিন্ন মস্তক বহন করে রুশ সামরিক কর্মকর্তার আঞ্চলিক রাজধানীর দিকে ধাবিত হওয়ার বর্ণনা।

ফলে রাজনৈতিক নৃশংসতা হচ্ছে সেই অঞ্চলের একটি চলমান বৈশিষ্ট্য, যা থেকে এলাকাটি সম্ভবত এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। রুশ বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করে দেখলেও স্থায়ী সমাধান যে পেয়েছে তা অবশ্য নয়।

বিশেষ করে তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল চেচনিয়ার জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ওপর প্রশাসন গুরুত্ব আরোপ করায় চেচেনদের ওপর নেমে এসেছিল নানারকম নিষেধাজ্ঞা। ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নিয়ন্ত্রণের গিঁট কিছুটা হালকা হয়ে এলে সোভিয়েত ভূখণ্ডের অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া চেচেনদের বড় একটি অংশ আবারও নিজেদের ভূখণ্ডে ফিরে গেলেও অসন্তোষের বীজ ঠিকই থেকে যায়; পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় যা আবারও দানা বেঁধে উঠে।

আমরা জানি ১৯৯১ সালে পারস্পরিক আলোচনার মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটলে ১৫টি প্রজাতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধানে এই স্বাধীনতার বিষয়টির উল্লেখ থাকায় বৈধতার ঘাটতি সেই সিদ্ধান্তে ছিল না। তবে প্রশ্ন দেখা দেয় স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র চেচনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করায়। সাংবিধানিক বৈধতা সেই ঘোষণার পেছনে না থাকায় চেচেন নেতা জোখার দুদায়েভের সেই স্বাধীনতা ঘোষণাকে রাশিয়া দেখেছিল রাষ্ট্রদ্রোহমূলক তৎপরতা হিসেবে।

বরিস ইয়েলৎসিনের নেতৃত্বাধীন রুশ প্রশাসন আশঙ্কা করেছিল যে চেচনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা স্বীকৃতি পেলে রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য এ কারণে তা বিপদ সংকেত হয়ে দেখা দেবে যে রাশিয়ার অন্যান্য জাতিসত্তাও তখন হয়তো একই পথে ধাবিত হতে চাইবে। ফলে চেচনিয়ার স্বাধীনতার স্পৃহাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিতে সামরিক বাহিনীর সহায়তায় সরকার অগ্রসর হয় এবং চেচনিয়ার গৃহযুদ্ধের সূচনা সেখান থেকে, যে যুদ্ধ হয়েছিল মাঝে অল্প কিছুদিনের বিরতি দিয়ে দুই পর্বে।

প্রথম চেচেন যুদ্ধ ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়ে প্রায় দুই বছর ধরে চলে। ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে দুই পক্ষের মধ্যে একটি অস্ত্র বিরতি চুক্তির মধ্যে দিয়ে এর সমাপ্তি সূচিত হলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান তা এনে দিতে পারেনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জঙ্গি ইসলামের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়া ছিল এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ। প্রথম চেচেন যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট আসলাম মাসখাদভ চেয়েছিলেন রাশিয়ার অধীনে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন নিয়ে শান্তির জীবনে চেচেনরা যেন ফিরে যেতে পারে তা নিশ্চিত করে নিতে। তবে তার ঘনিষ্ঠ মহলের অনেকেই তত দিনে জঙ্গি ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং ককেশাস অঞ্চলে বৃহত্তর একটি খিলাফত রাজত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্য কয়েকটি অঞ্চলের ইসলামি জঙ্গিদের জিহাদে জড়িত হতে এটা উৎসাহিত করে এবং সেই সঙ্গে ঝোপ বুঝে কোপ মারার মানসিকতা নিয়ে ইউক্রেন ও জর্জিয়াসহ সাবেক সোভিয়েতের কট্টর রুশবিরোধী কিছু অংশও রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলা যুদ্ধে ইসলামি জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মেলায়।

এর বাইরে বিশেষত বসনিয়ার ঘটনাবলিও সেই পথ অনুসরণে এ রকম ইসলামি জঙ্গিদের উৎসাহিত করেছিল এবং শামিল বাসায়েভের মতো জঙ্গি চেচেন নেতা সম্ভবত ধারণা করে নিয়েছিলেন যে চেচনিয়াকে কেন্দ্রে রেখে ককেশাস অঞ্চলে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধ শুরু করা হলে পশ্চিমের সহমর্মিতা লাভে তারা সক্ষম হবেন।

তবে রাশিয়ার একেবারে ভেতরে গিয়ে সেরকম এক বিদ্রোহী তৎপরতায় জড়িত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে আঁচ করতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা মিত্রদের কেউই চেচেন নেতৃত্বের একটি অংশের সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্মত হতে পারেনি। ফলে বাসায়েভ এবং বহিরাগত ইসলামি জঙ্গি নেতা ইবন-আল-খাত্তাবের নেতৃত্বে চেচেন ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা জঙ্গি ইসলামিদের একটি দল ১৯৯৯ সালের গ্রীষ্মে চেচনিয়ার প্রতিবেশী প্রজাতন্ত্র দাগেস্তানে হামলা চালিয়ে সেখানকার কর্তৃত্ব গ্রহণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে এদের দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের বাইরে অন্য পথ ইয়েলতসিনের সামনে তখন আর খোলা থাকেনি।

সেই ঘটনা থেকে দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের শুরু, যেটা চলেছিল দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর এবং যে যুদ্ধে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপ্তি ছিল প্রথম চেচেন যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি। ইয়েলৎসিনের সময়ে যুদ্ধের সূচনা হলেও অচিরেই ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর চেচনিয়ার সংকটকে তিনি দেখেছিলেন তার প্রশাসনের সামনে দেখা দেওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে।

দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল এ রকম যে চেচেনদের মধ্যে বড় একটি দল যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে চলে আসে এবং জঙ্গি চেচেনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রমজান কাদিরভের বাবা আখমাদ কাদিরভ ছিলেন সেই দলের একজন এবং যুদ্ধ চলাকালে চেচেনদের রুশ সমর্থক নেতা হিসেবে তখন থেকেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন। ফলে চেচনিয়ার যুদ্ধ অনেকটাই হয়ে উঠেছিল নিজ ভূখণ্ডে জঙ্গি ইসলামের উত্থানের বিরুদ্ধে রাশিয়ার চালানো যুদ্ধ।

আখমাদ কাদিরভ পরবর্তীতে জঙ্গিদের চালানো হামলায় নিহত হলে পুত্র রমজান পিতার স্থলাভিষিক্ত হন এবং আরও বেশি নির্মমভাবে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। একই সঙ্গে রাশিয়া, বিশেষ করে পুতিনের কাছ থেকে এ রকম প্রতিশ্রুতি তিনি আদায় করে নিতে পেরেছিলেন যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিধ্বস্ত গ্রোজনির পুনর্নির্মানে সব রকম সহায়তা মস্কো দেবে। সেই প্রতিশ্রুতি পুতিন রেখেছেন এবং দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ জঙ্গিদের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার মধ্যে শেষ হওয়ার এক দশক পর গ্রোজনি এখন হয়ে উঠেছে সার্বিক অর্থে নতুন করে গড়ে তোলা আধুনিক এক শহর, রমজান কাদিরভের নেতৃত্বে চেচনরা যেখানে সুফি ভাবাদর্শের ইসলামের একটি ধারার চর্চা করছেন।

রমজান কাদিরভ কোনো অবস্থাতেই পরমত সহিষ্ণু নেতা নন। যুদ্ধের মর্মান্তিকতা সেরকম এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার সুযোগ তার জন্য করে দেয়নি। তবে নরপিশাচ তাকে কোন অবস্থাতেই আখ্যায়িত করা যায় না। পশ্চিম তাকে এ রকম নামে এ কারণে আখ্যায়িত করতে আগ্রহী যে কাদিরভ এবং তার বাহিনীর যুদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে এক ধরনের ভীতি এদের মধ্যে কাজ করছে। পাশাপাশি আছে প্রচণ্ড ঘৃণা।

এ কারণেই রমজান কাদিরভ যখন ঘোষণা করেছিলেন, চেচেন যোদ্ধাদের বাহিনী নিয়ে রুশদের পাশাপাশি তিনিও ইউক্রেনের যুদ্ধে যোগ দেবেন, জেলেনস্কির অনুসারীরা তখন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিল, চেচনিয়ার মুসলিম যোদ্ধাদের স্বাগত জানানোর জন্য গুলি আর সব রকম গোলা তারা শূকরের চর্বিতে ভিজিয়ে তৈরি করে রেখেছে। অন্যদিকে কাদিরভ ঘোষণা করেছিলেন, তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এবং তার যোদ্ধারা ইউক্রেনে যাচ্ছেন, যার মধ্যে দুটি-ইউক্রেনকে নাৎসিমুক্ত করা এবং দেশটিকে ন্যাটো মুক্ত করা একই সঙ্গে হচ্ছে পুতিনেরও লক্ষ্য। অন্যদিকে তৃতীয় যে লক্ষ্যের ঘোষণা কাদিরভ দিয়েছিলেন তা হলো ইউক্রেনকে শয়তানমুক্ত করা।

মারিউপোলের আশপাশে কাদিরভ বাহিনীর সাহসী লড়াইয়ের খবর পশ্চিমেও অজানা নয়। আর এ কারণেই ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে নাম লেখানোর জন্য পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের যেসব বিভ্রান্ত তরুণ ইউক্রেনের পথে গিয়েছে, এদের অনেকের মধ্যে কাদিরভ ভীতি কতটা গভীর তার আংশিক প্রমাণ মেলে ‘নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকসে’ কিছুদিন আগে প্রকাশিত সেরকম ভাড়াটে সৈন্যদের নিয়ে লেখা এক প্রতিবেদনে।

শুরুতে এই বিদেশি যোদ্ধাদের বড় একটি দল সমবেত হয়েছিল পশ্চিম ইউক্রেনের লভিব শহরের বাইরে ইয়াভোরিব ঘাঁটিতে। সেই ঘাঁটি লক্ষ্য করে চালানো রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সেই যোদ্ধা দলের শ’পাচেক বীরের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণ হারায় প্রায় ২০০ জন এবং অবশিষ্টদের বড় এক অংশ প্রাণভয়ে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয় পোল্যান্ড, রোমানিয়া ও অন্য কয়েকটি দেশে। এঁদেরই একজনের উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ইউক্রেনের যুদ্ধে যোগ দিতে আগ্রহীদের প্রতি যে উপদেশ তিনি এখন টুইটার বার্তায় নিয়মিতভাবে দিচ্ছেন তা হলো, এ কথা এদের সব সময় স্মরণে রাখা দরকার যে কাদিরভের হাতে এরা যেন কখনো ধরা না দেয়।

প্রথম আলোয় পুতিন-কাদিরভকে নিয়ে লেখা কলাম আবারও প্রমাণ করছে যে ইউক্রেনের যুদ্ধকে আমরা শুরু থেকে দেখে আসছি পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের চোখ দিয়ে, যে চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ কখনোই নয়। আমাদের সেই কলম যোদ্ধা দলের কেউ কেউ এমনকি পশ্চিমের যে সব বিশ্লেষণকে স্বচ্ছভাবে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে প্রয়াসী, তাদেরও ‘এরা ভুল এবং আমি ঠিক বলে’ বুক চিতিয়ে নাকচ করে দিতে পিছপা হচ্ছেন না। ফলে কাদিরভকে আমরা জানছি এমন এক নরপিশাচ হিসেবে, মানুষের রক্ত পান করতে যে কিনা অভ্যস্ত এবং পুতিনকে আমরা দেখছি যেন ঠান্ডা মাথার এক খুনি।

যুদ্ধে সব সময় সবচেয়ে বেশি প্রাণ যায় উলুখাগড়ার। সংঘাতময় বিভিন্ন এলাকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তা যেন হচ্ছে সেরকম উলুখাগড়া। স্বাধীন চেতনা এদের চাপা পড়ে যায় পাথরের নিচে। আর এ কারণেই সম্ভবত লেভ তলস্তয় তার ‘হাজি মুরাত’ উপন্যাস শুরু করেছিলেন এ রকম বর্ণনা দেওয়ার মধ্য দিয়ে: ‘পাথর সরিয়ে নেওয়ার পর সেখানে ধূসর রং ধারণ করা ঘাসের দিকে চোখ পড়তে আমার মনে পড়ে গেছে হাজি মুরাত আর ককেশাস অঞ্চলের সেই সব জাতিগোষ্ঠীর কথা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা যাদের রয়েছে পাথর চাপা অবস্থায়। তবে পাথর সরিয়ে নিলেই আবারও দেখা যায় ধূসর রং ধারণ করা ঘাস আলোর স্পর্শে মাথা তুলে জেগে উঠছে।’

ফলে এই সব জাতিসত্তা এবং এদের নেতারা আমাদের কাছ থেকে অন্তত এটুকু দাবি করতে পারে যে বাস্তবকে বিসর্জন না দিয়ে অন্যের চোখে আমরা যেন এদের যাচাই করে না দেখি।

মনজুরুল হক জাপান প্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক