গত ২১ এপ্রিল খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ইস্টার সানডে উৎসবের দিন শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোসহ তিনটি শহরে আটটি সমন্বিত আত্মঘাতী বোমা হামলার এক সপ্তাহ পর ২৯ এপ্রিল ইন্টারনেটে ১৮ মিনিটের এক ভিডিওচিত্রে আবির্ভূত হন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) প্রধান নেতা আবুবকর আল–বাগদাদি। এটা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বেশ শোরগোল শুরু হয়েছে। কারণ, ধারণা করা হয়েছিল, তিনি নিহত হয়েছেন কিংবা গুরুতর আহত হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন, আইএস এখন নেতৃত্বশূন্য। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি, তারা বাগদাদিকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আড়াই কোটি মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে রেখেছে।
বাগদাদি নতুন ভিডিওচিত্রে আবির্ভূত হয়ে বিশ্ববাসীকে তো বটেই, তাঁর সংগঠনের সদস্য ও অনুরাগীদেরও জানিয়ে দিলেন যে তিনি শুধু জীবিতই নন, সক্রিয়ও আছেন। তিনি এই বার্তা প্রচারের প্রয়োজন বোধ করেছেন সম্ভবত এই কারণে যে এর মাসখানেক আগেই ইসলামিক স্টেট সিরিয়ায় তাদের সর্বশেষ ঘাঁটি বাগুজ থেকে উৎখাত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়া–ইরাকজুড়ে তাদের স্বঘোষিত খিলাফতের পতন ঘটেছে। এই পতন ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের জন্য বিরাট হতাশার বিষয়, এটা তাদের মনোবল ধসিয়ে দিয়ে থাকতে পারে। কারণ, ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা শুধু একটি জিহাদি সংগঠন হিসেবে সারা দুনিয়ায় তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াকেই চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেনি, তারা নিজেদের একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও স্বপ্ন দেখেছিল। সেই পথে তারা অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছিল। তারা ইরাক ও সিরিয়ার মাঝখানের সীমান্তরেখা তুলে দিয়ে ওই দুই দেশের বিরাট অংশ দখল করে ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করেছিল; তাদের নিয়ন্ত্রিত সেই ভূখণ্ডের আয়তন ছিল যুক্তরাজ্যের আয়তনের সমান। তারা সিরিয়ার অন্যতম বৃহত্তম শহর রাকায় তাদের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিল; ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলকে বানিয়েছিল দ্বিতীয় রাজধানী। ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিতে আবুবকর আল–বাগদাদি ২০১৪ সালের রমজান মাসের প্রথম দিন মসুলের আল নুরি মসজিদে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে তিনি নিজেকে ‘খিলাফতের’ আমিরুল মুমেমিন বা খলিফা ঘোষণা করেছিলেন।
সিরিয়ায় সেই খিলাফতের চূড়ান্ত পতনের কথা বাগদাদি তাঁর নতুন ভিডিও–ভাষণে স্বীকার করেছেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে জিহাদি সংগঠন হিসেবে ইসলামিক স্টেটেরও পতন ঘটেছে। আরবিতে দেওয়া তাঁর ভাষণের যে ইংরেজি অনুবাদ সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ প্রকাশ করেছে, সেখানে বাগদাদি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আমাদের এখনকার লড়াই শত্রুপক্ষের শক্তি ক্ষয় করার লড়াই; শত্রুদের জন্য আমরা এই লড়াইকে দীর্ঘায়িত করব; আমরা তাদের জানিয়ে দিতে চাই, জিহাদ চলবে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত।’
বাগদাদি কেন সিরিয়ায় পতনের পরপরই এই ভিডিও–ভাষণ দেননি? কেন শ্রীলঙ্কায় হামলা পর্যন্ত এক মাসের বেশি সময় অপেক্ষা করলেন? আমার ধারণা, সিরিয়ায় পতনের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামিক স্টেট থেমে যায়নি, বরং বেশ সক্রিয় আছে এবং খুব বড় আকারের সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে একসঙ্গে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে সক্ষম—এটা শুধু মুখে বলার চেয়ে দৃষ্টান্তসহকারে ঘোষণা করার প্রয়োজন বোধ করেছেন বাগদাদি। শ্রীলঙ্কায় হামলার পর তিনি সেই দৃষ্টান্ত দেখানোর সুযোগ পেয়েছেন। তিনি তাঁর ভাষণে এই কথাও বলেছেন যে শ্রীলঙ্কায় হামলা সিরিয়ার বাগুজে ইসলামিক স্টেটের পরাজয়ের প্রতিশোধ।
ভিডিওচিত্রে বাগদাদির পুনরাবির্ভাবের ঘটনাটিকে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে ইসলামিক স্টেটের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই অধ্যায়ে ইসলামিক স্টেটের কোনো নির্দিষ্ট নিজস্ব ভূখণ্ড থাকছে না, কিন্তু তাদের জিহাদি কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকছে। তারা নিজেদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। কারণ, তাদের সন্তানেরা বড় হচ্ছে। ৯ মে লন্ডনের দ্য টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, ইরাকের সরকার সে দেশের প্রায় ৪৫ হাজার শিশুকে ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের ছেলেমেয়ে হিসেবে শনাক্ত করেছে। ইরাকের যেসব এলাকায় আইএস তাদের খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেসব এলাকায় ওই শিশুদের জন্ম হয়েছে। আইএস কর্তৃপক্ষ ওই শিশুদের জন্মসনদ দিয়েছিল, তাদের খিলাফতের পতনের পর সেই সব জন্মসনদ বাতিল হয়ে গেছে। ইরাকি সরকার এখন ওই শিশুদের কোনো পরিচয়পত্র দিচ্ছে না, স্কুলে ভর্তি হতে দিচ্ছে না, স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে না। নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল বলছে, পাশের দেশ সিরিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রায় ৩০ হাজার ইরাকি মানুষ আছে, তাদের প্রায় ৯০ শতাংশই আইএস যোদ্ধাদের স্ত্রী ও শিশুসন্তান। সিরিয়ার সরকার তাদের বের করে দিলে তারা যদি ইরাকে ফিরে আসে এবং ইরাকের সরকার যদি তাদের ঢুকতে দেয়, তাহলে ইরাকে আইএস যোদ্ধাদের সন্তানের সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যাবে। ইরাকি সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ১ লাখ লোককে ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত সন্দেহে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। তারা আইএস যোদ্ধা সন্দেহে অনেক লোককে সংক্ষিপ্ত বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে। ইরাকি সরকার শুধু চলতি বছরেই প্রায় ৫০০ সন্দেহভাজন আইএস যোদ্ধাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
৮ মে নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ইরাকি সরকার প্রায় ১৪ হাজার বিদেশি নারী–পুরুষকে বন্দী করে রেখেছে, যারা আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইরাকে গিয়েছিল। পত্রিকাটি লিখেছে, আইএসের স্বঘোষিত খিলাফত গড়ে তোলায় সহযোগিতা করার জন্য বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ থেকে প্রায় ৪০ হাজার যোদ্ধা ইরাক–সিরিয়ায় গিয়েছিল; তাদের অনেকেই স্ত্রী ও শিশুসন্তানদের সঙ্গে নিয়ে ‘খিলাফতে’ যোগ দিয়েছিল। অনেক যোদ্ধা–দম্পতির সন্তানদের জন্ম হয়েছে সেখানেই। সিরিয়া–ইরাকে সরকারি ও বহুপক্ষীয় বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে তাদের অনেকে মারা গেছে। একটার পর একটা লড়াইয়ে যখন তাদের পরাজয় ঘটছিল, তখন তাদের অনেকে অন্য দেশে পালিয়ে গেছে কিংবা নিজের দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু যারা পালাতে পেরেছে, তাদের সবাই স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে নিতে পারেনি। সিরিয়ায় আইএসের সর্বশেষ ঘাঁটির পতনের পর দেখা যাচ্ছে, সে দেশে প্রায় ১৩ হাজার বিদেশি মানুষ আটকা পড়েছে, তাদের মধ্যে ১২ হাজারই নারী ও শিশু।
ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আইএস যোদ্ধাদের সন্তানদের আখ্যায়িত করা হচ্ছে ‘টাইম বোমা’ বলে। অর্থাৎ তারা বেড়ে উঠছে বৈশ্বিক নিরাপত্তার পক্ষে বিরাট হুমকি হিসেবে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সিরিয়া–ইরাকে আইএসের খিলাফতে যোগ দিতে পৃথিবীর যেসব দেশ থেকে জিহাদি নারী–পুরুষেরা গিয়েছিল, তাদের একটা বড় অংশ ইউরোপ–আমেরিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। যেমন যুক্তরাজ্য থেকে গিয়েছিল প্রায় ৯০০ জন। কিন্তু যুক্তরাজ্য সরকার তাদের ফেরত নিতে চায় না। সিরিয়া–ইরাকে গেছে এমন ১৫০ জন ব্রিটিশ নাগরিকের পাসপোর্ট ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে বলে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন। অস্ট্রেলিয়া থেকেও অনেক জিহাদি নারী–পুরুষ আইএসের খিলাফতে যোগ দিতে সিরিয়া–ইরাক গেছে, অস্ট্রেলিয়ার সরকার তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে। রাশিয়া, কসোভো, কাজাখস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও ফ্রান্স—শুধু এই পাঁচ দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের সিরিয়া–ইরাক থেকে স্বদেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে বলে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে। এই দেশগুলোর সরকার এসব জিহাদি নারী–পুরুষ ও তাদের সন্তানদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার পর কী করবে, তা অবশ্য নিউইয়র্ক টাইমস বলেনি।
ইসলামিক স্টেটের ভাবাদর্শ ও সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্যগুলোর একটা হলো, যেসব পুরুষ এর সঙ্গে যুক্ত হয়, তারা নিজেদের পরিবারের সব সদস্য ও বন্ধুবান্ধবকে নিজেদের সহযোদ্ধা হিসেবে পাওয়ার চেষ্টা করে। আইএস যোদ্ধাদের নারী সঙ্গীরা তাদের বিশাল প্রেরণা ও মনোবলের উৎস; নারীরাও অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ থেকে এমন নারী–পুরুষেরা ‘খিলাফতে’ যোগ দিতে সিরিয়া–ইরাক গিয়েছিল—এর মানে এই নয় যে বিশ্বের বাকি দেশগুলোতে আইএসের অনুসারী নেই। বিশ্বের যেখানেই মুসলমান আছে, আইএসের ভাবাদর্শের অনুসারী নারী–পুরুষ সেখানেই আছে। তাদের অনেকেই গোটা পরিবারসুদ্ধ জিহাদি; তাদের সন্তানেরাও সেভাবেই বেড়ে উঠছে। সিরিয়া–ইরাকে পরাজিত আইএস যোদ্ধাদের অবশিষ্ট যারা আটকা পড়েছে, তাদের সবাইকে যদি স্ত্রী–সন্তানসহ নিশ্চিহ্ন করে ফেলাও হয়, তবু তাদের অস্তিত্ব ও কর্মকাণ্ডের অবসান ঘটবে না। কারণ, এই প্রাণপণ যুদ্ধের পেছনে আছে প্রচণ্ড শক্তিশালী ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শ। সেটা যে ধ্বংসাত্মক ও মানবতাবিরোধী, এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ চালিয়ে সেই ভাবাদর্শের বিলোপ ঘটানো কি সম্ভব হবে?
নাকি তাদের ঘৃণা, বিক্ষোভ, জিঘাংসার মূল কারণগুলো দূর করার কাজে হাত দিতে হবে?
মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
mashiul.alam@gmail.com