শ্রদ্ধাঞ্জলি

আলো দিয়ে আলো জ্বেলে গেছেন যিনি

সুফিয়া কামাল
সুফিয়া কামাল

১৯১১ সাল, যে বছর বেগম রোকেয়া কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, সে বছরই সুফিয়া কামালের জন্ম, বরিশালের শায়েস্তাবাদে। পরবর্তী সময়ে এই দুই মহৎ প্রাণের যোগসূত্র ঘটে বাংলায় নারীর জাগরণ এবং শিক্ষা ও সাহিত্য সাধনাকে কেন্দ্র করে। তাঁরা দুজনই শৈশবে বাংলা পড়েছিলেন পারিবারিক ও সামাজিক বাধা অগ্রাহ্য করে। রোকেয়ার মতো শৈশবে সুফিয়ার জন্যও বাংলা বই ও স্কুলের দরজা বন্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও মায়ের সহায়তায় বাড়িতে তিনি বাংলা শেখেন, কলকাতা থেকে পত্রিকা আনিয়ে পড়েন। আরও পরে সুফিয়া কলকাতায় গেলে বেগম রোকেয়ার সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর কাছে শিক্ষা ও নারীমুক্তির আন্দোলনের দীক্ষা নেন। কলকাতায় তিনি বেগম রোকেয়া ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ লেখক-কবির সাহচর্যে আসেন। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন কাজী নজরুল ইসলামের উৎসাহে। পরে তিনি সওগাতের বিশেষ নারী সংখ্যার সম্পাদক হন। বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। তরুণ বয়সে তাঁর চিন্তা-চেতনার ছাপ পাওয়া যায় মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে লেখা এক চিঠিতে। ১৯২৯ সালে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি আমার কাজ করে যাব, নীরবে, নিঃশব্দে। আমি পথের কাঁটা সরিয়ে যাব—এরপর যারা আসবে, যেন কাঁটা না ফোটে তাদের পায়ে, তারা যেন কাঁটাবিদ্ধ পথে পিছিয়ে না পড়ে। ওইটুকু আমি করব, আমার যতটুকু শক্তি আছে, তা দিয়ে।’ আমাদের ধারণা, তিনি শক্তির চেয়েও বেশি কিছু করেছিলেন।
সুফিয়া কামালের বহুমাত্রিক পরিচয়। কবি, সমাজসেবী ও নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ। তাঁর সাঁঝের মায়া কিংবা মায়া কাজল-এর কবিতা এখনো পাঠককে প্রাণিত করে। বাঙালি মুসলমান সমাজে যখন নারীরা চার দেয়ালে বন্দী, সুফিয়া কামাল তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই তিনি কলকাতা সিটি করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সে সময়ে দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভিঘাতে কলকাতায় বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। সুফিয়া কামাল বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে আক্রান্ত ও পীড়িত মানুষকে সেবা দেন।
দেশভাগের পরে ঢাকায় এলে তাঁর কর্মপরিধি আরও বেড়ে যায়। এখানেও লীলা নাগ প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে তাঁকে দাঙ্গাপীড়িত মানুষের সহায়তায় হাত বাড়াতে হয়। তিনি ঢাকায় এসে নারীদের নিয়ে সংগঠন করলেন, লেখক-কবি-শিল্পীদের সংগঠিত করলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একষট্টির রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কিংবা উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান কিংবা একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলন—সবটাতেই অগ্র সারিতে ছিলেন তিনি। যেখানেই থাকুন না কেন, সুফিয়া কামাল সংগঠনকে ছাড়িয়ে সর্বজনীন হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। দলমত-নির্বিশেষে সবাই তাঁর কাছে যেতেন একটু সান্ত্বনা, অভয় ও আশ্রয়ের জন্য। তিনি কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না।
পাকিস্তান বা বাংলাদেশ আমলে যখনই কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক বিপর্যয় ঘটত, তিনি এগিয়ে এসেছেন। সভায় তিনি কম কথা বলতেন কিন্তু মোক্ষম কথাটি বলতেন। মৌলবাদীদের সংঘবদ্ধ আক্রমণ কিংবা স্বৈরাচারের ভ্রুকুটি তাঁকে টলাতে পারেনি। পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খানের মুখের ওপর তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘দেশের মানুষ যদি হায়েনা হয়, তাহলে তো আপনি সেই হায়েনাদের প্রেসিডেন্ট।’
এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অবরুদ্ধ থেকেও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ ও খাবার সংগ্রহ করে তাঁদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পাকিস্তান সরকার তাঁর কাছ থেকে মিথ্যা বিবৃতিতে সই নিতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন, তার বিবরণ আছে, তাঁর একাত্তরের ডায়েরিতে।
স্বৈরশাসক এরশাদ যখন শহীদ মিনারে ফুল দেওয়াকে বেদাত বলেছিলেন; তাঁর বিরুদ্ধেও সুফিয়া কামাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন আরও অনেককে নিয়ে। তিনি নম্রভাষী ছিলেন, কিন্তু প্রয়োজনে জ্বলে উঠতে দ্বিধা করতেন না; একবার মৌলবাদীদের আস্ফালন দেখে তিনি বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী মানুষগুলো এক হলে ওই গুটিকয়েক দানবকে পিষে ফেলতে পারবে।
সুফিয়া কামাল নিজে ধর্মীয় আচার মেনে চলতেন, কিন্তু সেটিকে কখনোই প্রদর্শনের বিষয় করতেন না। তাঁর বাড়িতে কোনো বৈঠক চলাকালে নামাজের সময় হলে তিনি একটু সময় চেয়ে নিয়ে ভেতরে চলে যেতেন এবং নামাজ শেষে বৈঠকে যোগ দিতেন।
সুফিয়া কামাল নিজের লেখনী, সৃষ্টিশীলতা কিংবা প্রাত্যহিক কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের শুভবোধকে জাগ্রত করেছেন, মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে আলো ছড়িয়েছেন। আসলে তিনি ছিলেন আলো দিয়ে আলো জ্বালানো মানুষ। নারীর ওপর নৃশংসতা কিংবা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ক্ষেত্রে সুফিয়া কামাল তরুণ প্রজন্মকে অগ্রাধিকার দিতেন; তাদের সুকুমার বৃত্তি গঠন কিংবা সৃজনশীলতায় বিকাশকে অনুপ্রাণিত করতেন; নারীকে আপন ভাগ্য গড়ে তোলার কথা বলতেন। আজ সামাজিক অবক্ষয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের ওপর যখন জুলুম হচ্ছে, তখন তাঁর অনুপস্থিতি আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে।
১৯৯২ সালে ভোরের কাগজ-এ এক সাক্ষাৎকারে সুফিয়া কামাল বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র যদি হয়, তাহলে সেখানে কথা বলার স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। তা হচ্ছে কই! দুঃখ হচ্ছে সরকার মহিলাদের সমস্যা জানার, বোঝার চেষ্টা করছে না। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী মহিলা হলেই নারীর অধিকার আদায় হয় না। নারীর অধিকার আদায় করতে হলে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র এবং সমাজের গণতন্ত্রায়ণ হতে হবে।’ সেই গণতন্ত্র এবং নারীর সত্যিকার ক্ষমতায়ন এখনো অধরা।
শৈশবে ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি যে বিদ্রোহ করেছিলেন, সেই বিদ্রোহ আজীবন লালন করেছেন, নিজেকে তৈরি করেছেন; তিনি নিজে যেটুকু শিখেছেন, সেটাই সমাজকে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন—লেখায় ও সেবাধর্মে। সুফিয়া কামাল অশুভের বিরুদ্ধে শুভ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় এবং অমানবিকতার বিরুদ্ধে মানবিকতার যে মশাল জ্বেলে গেছেন, সেটি এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব উত্তর প্রজন্মেরই।
মৃত্যুদিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com