ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। এখন উভয় পক্ষই চাইছে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে নিজের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে কীভাবে অন্য পক্ষের ক্ষতিটা বেশি করা যায়। এদিকে নয়াদিল্লি নিজের রাগ দেখাতে গিয়ে ইসলামাবাদের সঙ্গে আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে, যেটা অতীতেও হয়েছে। তাই সে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় সার্ক সম্মেলন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। একই সঙ্গে আরও কয়েকটি দেশও এতে যোগ দিচ্ছে না। তারা হয়তো ভারতের প্রভাবে এ কাজ করছে অথবা পাকিস্তানের ওপর তাদেরও রাগ আছে। নয়াদিল্লির চিন্তা হচ্ছে, তারা ইসলামাবাদকে একঘরে করে তাকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিতে চায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, জঙ্গিবাদের নেতৃত্বে মূলোৎপাটন করতে ও কূটনৈতিক বিজয় লাভের জন্য সময় লাগবে। এদিকে বাংলাদেশ, ভুটান ও আফগানিস্তান ভারতের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেও এ অঞ্চলেও বাইরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র পরিস্থিতিতে নজর রাখছে। কিন্তু তারা ভারতের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে না। তারা হয়তো পুরোপুরি নিশ্চিত নয়, কারা এর পেছনে আছে, অথবা এই কূটনৈতিক ও সামরিক রেষারেষির ফল কী হবে, সে ব্যাপারে এমনিতেই সতর্ক।
যা-ই হোক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনাগ্রহী, এমনকি তারা যদি এ ব্যাপারে নিশ্চিতও হয় যে মুম্বাই হামলা ও পাঠানকোট হামলায় পাকিস্তানের কোনো রকম হাত ছিল। এর কারণ হচ্ছে, অন্য রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থের জায়গা থেকে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। যেমন ব্রিটেনের কথাই বলা যায়, দেশটির সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে, পাকিস্তানের সরকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে হাত মেলালে লাভ আছে। কারণ, এতে তারা নিজ দেশের সন্ত্রাসীদের ধরতে পারবে। ফলে এসব হামলায় যে পাকিস্তানের হাত রয়েছে, আন্তর্জাতিক সমাজকে তা বোঝাতে এবং তাদের দিয়ে দেশটির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়াতে অনেক ঘাম ঝরাতে হবে।
আরও বড় ভয়ের কারণ হচ্ছে, এই কথার যুদ্ধ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। হতে পারে সত্যি সত্যিই যুদ্ধ লেগে যেতে পারে, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। আগের সময় আর নেই, যখন ভারত পাকিস্তানকে যুদ্ধে নিয়ে যেতে পারত, কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হতে পারে, তবে এর প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা আঘাতও নিশ্চিত। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রে বিনিয়োগ করেছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে, ভারত যদি সীমিত মাত্রায় হামলা করে, তাহলে তার জবাব দেওয়া। কারণ, ব্যাপারটা হচ্ছে, বিশ্লেষকেরা কারগিল থেকে পাকিস্তানকে সেনা প্রত্যাহারে তাগাদা দিতে পারেন, কিন্তু পাকিস্তানের ভেতরে যদি ভারত সামরিক হামলা চালায়, তাহলে ব্যাপারটা সে রকম না-ও হতে পারে।
>যত উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও বাগাড়ম্বর হোক না কেন, এই যুদ্ধের গতি বেশ ধীরই মনে হচ্ছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে, দুই দেশের জনগণকে সুড়সুড়ি দেওয়া
এমনকি জিহাদি সংগঠনগুলোও এই অস্ত্রের ঝনঝনানির তীব্রতা বাড়ার কারণ বোঝে। পাকিস্তানের প্রখ্যাত চিকিৎসক ও রাজনৈতিক কর্মী ড. এ এইচ নায়ার বলেছেন, পাকিস্তান ও ভারত পারমাণবিক অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে যেভাবে খোলাখুলি যুদ্ধংদেহী অবস্থান নিচ্ছে, তাতে সন্ত্রাসী দলগুলো আরও সাহস পেয়ে গেছে। তারা একটু বেশি দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে, কারণ তারা বুঝে গেছে, নয়াদিল্লির হাতে খুব বেশি পথ খোলা নেই। কথা হচ্ছে, নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা হয়তো গর্ব করতে পারেন, পারমাণবিক যুদ্ধ লাগলে ভারতের অন্তত অর্ধেক মানুষ বেঁচে যাবে, যদিও পাকিস্তানের অত লোক বাঁচবে না। তা ছাড়া দেশের অর্ধেক মানুষের মৃত্যুর বোঝা কোনো নেতাই বহন করতে চাইবেন না।
কথা হচ্ছে, প্রথাগত যুদ্ধ শুরু হলে পারমাণবিক যুদ্ধের ভূতটা আরও শক্তিশালী হতে পারে। এ কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন। এদিকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো হয়তো এভাবে হিসাব করেছে যে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনার কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হয়তো কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে আগ্রহী হবে। তারা কাশ্মীরের মানবতা লঙ্ঘনের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ না হলেও যুদ্ধের ঝনঝনানি শুরু হলে কিন্তু ঠিকই নড়াচড়া শুরু করবে।
যত উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও বাগাড়ম্বর হোক না কেন, এই যুদ্ধের গতি বেশ ধীরই মনে হচ্ছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে, দুই দেশের জনগণকে সুড়সুড়ি দেওয়া। নয়াদিল্লি তার জনগণকে বলছে, কীভাবে পাকিস্তানকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। অন্যদিকে ইসলামাবাদ তার জনগণকে বলছে, ভারত তেমন কিছুই করতে পারেনি। উপরন্তু তারা যে কাশ্মীরের হয়ে আবেদন-নিবেদন করছে, তাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাড়া দিচ্ছে। তবে এই দ্বন্দ্ব যদি দুই দেশের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে বিপদ আছে। কারণ, এতে মানুষের আশা বেড়ে যাবে, যা দুই দেশের সরকারকে অসাবধানতাবশত অনেক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।
এখন কথা হচ্ছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বা শান্তির সম্ভাবনা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। এই উত্তেজনা বাড়লে স্বল্প মেয়াদে ভালো কোনো ফলাফল পাওয়া যাবে না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেটা অনেকেই প্রত্যাশা করছেন। কোন পরিবর্তন হলে কী হবে, তা বোঝার জন্য দীর্ঘদিন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এতে আরও জাতীয়তাবাদী ধুয়া তুলতে পারছে, তার সামাজিক অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ মানুষকে খাওয়াতে পারছে। আর নওয়াজ শরিফ অক্ষরে অক্ষরে তাঁদের পাণ্ডুলিপি অনুসরণ করলেও তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তিনি নরেন্দ্র মোদির পোষা কুকুর।
এবার পানির প্রসঙ্গে আসি। কথা হচ্ছে, পানির মতো এমন অভিন্ন সম্পদ ভারত একতরফা প্রত্যাহার করে নিলেও তার তাৎক্ষণিক প্রভাব অনুভূত হবে না। পাকিস্তানকে একঘরে করার কথা বলে ভারত চুক্তি লঙ্ঘনের চেষ্টা করলে হালে পানি পাবে না। কিন্তু পাকিস্তানকে এই পরিণতির কথা মাথায় রাখতে হবে। তাকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। সে যদি উরি হামলায় জড়িত না–ও থাকে, তাহলেও নিজ দেশের মাটিতে সন্ত্রাসীদের নির্বিঘ্নে ঘুরতে দেওয়ার বিষয়টি তাঁকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। ওদিকে সিন্ধু পানি চুক্তি বা সবচেয়ে অনুগ্রহপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে ভারতের যে মর্যাদা রয়েছে, তা ভঙ্গ করার আগে নরেন্দ্র মোদিকে এর সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে হবে। কারণ, এসব করলে স্বল্প মেয়াদে সুবিধা পাওয়া যাবে, তেমন নিশ্চয়তা নেই।
ফলে এ পরিস্থিতিতে দুই দেশ যদি যুদ্ধ থেকে সরে এসে আলোচনার টেবিলে বসে, তাহলে তারা যথেষ্ট লাভবান হবে। তবে নয়াদিল্লি কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ বিবাদকে যথারীতি অগ্রাহ্য করায় শান্তি ও সম্ভাবনা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একটি প্রজন্মের মানুষ ক্ষুব্ধ ও হতাশ, ফলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে হলে মোদি সরকারকে ভিন্ন কিছু করতে হবে। সম্ভবত স্বল্প থেকে মধ্য মেয়াদে সমাধান পেতে হলে এটাই সবচেয়ে সঠিক মনোভঙ্গি। কথা হচ্ছে, পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আবেদন করে বা তাদের দারিদ্র্য বিমোচনের প্রতিযোগিতায় আহ্বান না করে কাশ্মীরে শান্তি ফিরিয়ে আনা গেলে তা দীর্ঘ মেয়াদে অনেক কাজে দেবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য হিন্দু থেকে নেওয়া।
আয়েশা সিদ্দিকা: ইসলামাবাদভিত্তিক কলামিস্ট।