আলু বেশি রহস্যময়, নাকি বাজার বেশি রহস্যে ভরা—এ নিয়ে ধন্দে আছি। চিরকাল শুনে এসেছি—বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপরে চাপ কমান। কারণ, বাংলাদেশে আলুর চাষ হয় বেশি, ফলন হয় বেশি, ফলে আলুর দাম কমে বালুর চেয়েও সস্তা হয়ে যায়, গরুও তখন আর আলু খেতে চায় না। চাষিরা রাস্তায় আলু ফেলে দেন। বিচারপতি সাত্তার যখন দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তখন খবর পত্রিকায় শিরোনাম করেছিল, ‘ভাতের বদলে আলু খান: সাত্তার’। ইত্তেফাক পত্রিকায় সেই খবরের শিরোনাম ছিল, ‘আমাদের খাদ্যাভ্যাস বদলাইতে হইবে—রাষ্ট্রপতি’। দুই উদ্দীন—ফখরুদ্দীন আর মইন উদ্দীন যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালাচ্ছিলেন, তখনো সবাইকে বেশি করে আলু খেতে বলা হতো। আলু দিয়ে কত–কী হয়, কত প্রকার রেসিপি হতে পারে আলুর, সেসব নিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নানা ধরনের অনুষ্ঠান হতে লাগল।
এখন শুনছি, আলুর দাম নাকি গেছে বেড়ে। অথচ সরকারি হিসাবে দেখছি, বছরে আলু আমরা খাই ৭৭ লাখ টন, ২০ লাখ টন লাগে বীজ হিসেবে, মানে সাকল্যে লাগবে ৯৭ লাখ টন, উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ টন। মানে ১২ লাখ টন এবারও গরু-ছাগলেরই পেটে যাওয়ার কথা। বাতাসে হেমন্তের টান, শীত এসে গেল বলে, নতুন আলু তার পাতলা ফরসা ত্বক নিয়ে আমাদের ফুলকপির ঝোলের পাশে রুপের ঝলক দেখাবে, সে আর কদিন। তো এখন যদি মজুতদারেরা হিমাগারে আলু স্টক করে রাখেন, দুই দিন পরে তা ফেলে দেওয়ার ফুরসত, জায়গা, লোকবলই–বা কোথায়?
তাহলে আলুর দাম বেশি কেন? সরকার তাই আলুর দাম দিয়েছে বেঁধে। আলু ৩০ টাকা কেজির বেশি বাজারে বিকোনো চলবে না। এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়া বাজারে কী হয়েছে, জানার চেষ্টা করলাম। আমাদের গৃহপরিচারিকা গতকাল কিনেছেন ৫০ টাকা কেজি, আজকে আমার চালক জানালেন বাজারে নাকি ৬০ টাকা করে আলু বিকোচ্ছে। বহুদিন আগে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী লিখেছিলেন, সরকার যখন শত ফুল ফোটাতে চায়, তখন বাগানের সব ফুল শুকিয়ে ঝরে পড়ে যায়। আর আকবর আলি খান তাঁর পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে লিখেছেন, অর্থনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান নেই। নিজের জীবনে প্রশাসনিক কর্মকর্তার অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখেছেন, একবার দুধের দাম বেশি হওয়ায় দুধে পানি মেশালে জরিমানা করার ব্যবস্থা করা হলো। দেখা গেল, দাম আরও বেড়ে গেছে। কারণ, পরিদর্শকদের উৎকোচদানের খরচও দুধওয়ালাদের পানি থেকে বা বর্ধিত দাম থেকে তুলে নিতে হচ্ছে। তাঁর মত হলো, দুধের দাম বেড়ে গেলে তার সমাধান দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি।
কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ধন্দে ফেলার জন্য যথেষ্ট। ১২ লাখ টন উদ্বৃত্ত আলুর বছরে দাম যেখানে পড়ে যাওয়ার কথা, সেখানে বাড়ছে কেন।
আমার কাছে এই সমস্যার সমাধান হলো আসুন, আমরা আলু বর্জন করি। আলুর ইতিহাস সাম্রাজ্যের ইতিহাস, উপনিবেশের ইতিহাস। শ পাঁচেক বছর আগে আলু দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসে ইউরোপে। এই শর্করা অচিরেই ইউরোপের খাদ্যসংকট সমাধানে আশীর্বাদ হয়ে ওঠে। পেটে খাদ্য থাকায় ইউরোপীয়রা সাম্রাজ্য বিস্তারে বেরিয়ে পড়ার অবকাশ পায়। মহাদেশে মহাদেশে উপনিবেশ গড়তে থাকে। উইলিয়াম এইচ ম্যাকগেইল নামের ইতিহাসবিদ তাই বলেছেন। ১৭৫০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক হওয়ার পেছনে ছিল আলুর শক্তি।
অন্য অনেক কিছুর মতো বাংলায় আলু চাষের প্রবর্তনে রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা ঋণী। তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথকে আমেরিকার শিকাগোয় পাঠান কৃষিবিজ্ঞান শিখতে, রথীন্দ্রনাথ দেশে এসে বাবার উৎসাহে বৈজ্ঞানিক কৃষি প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। আলু চাষের পাইলট প্রজেক্ট তাঁদেরই নেওয়া।
তবে রবীন্দ্রনাথ নাকি ডি এল রায়ের পদ্ধতিতে আলু চাষ করার চেষ্টা করেছিলেন, সেই চেষ্টা মাঠে মারা পড়েছিল। ডি এল রায় বিদেশ থেকে কৃষিবিজ্ঞান পড়ে এলেন, এসে রবীন্দ্রনাথকে শেখালেন কীভাবে আলুর বীজ লাগাতে হয়। কৃষকেরা মাথায় হাত দিলেন। এভাবে লাগালে হবে না হুজুর। চাষা আর বিজ্ঞানী, কার কথা শুনবেন কবি? শেষে শুনলেন ডি এল রায়ের কথা এবং পুরোটাই পণ্ডশ্রম হলো।
রবীন্দ্রনাথের জন্ম আগে, নাকি গোপাল ভাঁড়ের? গোপাল ভাঁড় যে বাজারে আগুন লাগার পর পোড়া আলু খেয়ে বলেছিলেন, আবার কবে লাগবে, সেটা রবীন্দ্রনাথের আগে না পরে? বোঝাই যাচ্ছে, এই সব গল্প আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বানাই, আর গোপাল ভাঁড় কিংবা বীরবলের নামে চালু করি। যেমন আলুর একটা দোষ ধরা হয়, যে আলু সব তরকারিতেই চলে। আলু মাছেও চলে, মাংসেও চলে, ভাতেও চলে,
রুটিতেও চলে, ভর্তাও হয়, ভাজিও হয়, রংপুরের আলুর ডাল তো অতি উপাদেয়। আলু শিঙাড়ায় দিন, পুরিতে দিন, পরোটায় দিন, আলু মানেই চালু। হোক। হোক। আলুর বহু গুণ আছে, মানলাম। তবে ১৫টা দিন আলু বর্জন করে দেখুন। আলুর দাম তরতর করে নেমে যায় কি যায় না। নতুন আলু উঠতে শুরু করলেই হিমাগারগুলো খালি করতেই হবে। তখন পুরোনো আলু যাবে কোথায়?
এসেছে নতুন আলু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে চলে যেতে হবে পুরোনো আলুকে।
চালের দাম চড়া, আলুর দাম কড়া। ভাতের বদলে আলু খাব, সে উপায় নেই। আলুর বদলে ভাত খাব, তাও হবে না। কিছু বললেই শুনি সিন্ডিকেট। তো এই সিন্ডিকেট জিনিসটা কী? সিন্ডিকেট কত প্রকার?
চাল সিন্ডিকেট, খাল সিন্ডিকেট, আলু সিন্ডিকেট, বালু সিন্ডিকেট, পেঁয়াজ সিন্ডিকেট, লবণ সিন্ডিকেট। এত সিন্ডিকেট দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট নিশ্চয়ই লজ্জা পাবে।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক