কাঠগড়ায় নিক্সন-কিসিঞ্জার
রিচার্ড নিক্সন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত। তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। তাঁরা বিশ্বকে কীভাবে দেখেছেন, সমসাময়িক বিশ্ব তাঁদের কীভাবে মূল্যায়ন করেছে, সেসব উঠে এসেছে টিম ওয়েনারের ওয়ান ম্যান অ্যাগেইনস্ট দ্য ওয়ার্ল্ড: ট্র্যাজেডি অব রিচার্ড নিক্সন বইয়ে।
৯/১১ বা নাইন-ইলেভেন বলতে এখনকার পাঠকের কাছে ২০০১ সালের রক্তাক্ত সেপ্টেম্বরই বেশি পরিচিত। আল-কায়েদার সন্ত্রাসীরা সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যকেন্দ্র টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে দিয়েছিল, যাতে তিন হাজারের মতো মানুষ মারা গেছে। কিন্তু এর ২৮ বছর আগে ১৯৭৩ সালে এই ১১ সেপ্টেম্বরেই চিলিতে ঘটে আরেকটি হত্যাযজ্ঞ। সেনাবাহিনীর প্রধান পিনোশের নেতৃত্বে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে চিলির প্রথম কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে নিহত হন। ওয়াশিংটন প্রথমে সেই সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে তাদের যোগসূত্রের কথা অস্বীকার করলেও পরবর্তীকালে মার্কিন দলিলপত্রে বেরিয়ে আসে প্রকৃত তথ্য।
কিউবান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলেন্দের অভ্যুদয়কে যুক্তরাষ্ট্র দেখেছিল সমগ্র লাতিন আমেরিকায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংকেত হিসেবে। প্রথমে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি আলেন্দের ক্ষমতারোহণ ঠেকাতে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেন। পরে সেটি করতে ব্যর্থ হয়ে তাঁরা আলেন্দের বিরুদ্ধে জনগণ ও সেনাবাহিনীকে খেপিয়ে দিতে লাখ লাখ ডলার ঢালেন, দেশব্যাপী ধর্মঘট ঢাকতে পেশাজীবীদের উসকানি দেন, অনুগতদের কাছে পাঠান অস্ত্রের চালান।
টিম ওয়েনারের বই সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১৯৭০ সালের ২২ অক্টোবর হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন যখন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকোর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, তখন ওয়াশিংটন থেকে পাঁচ হাজার মাইল দক্ষিণে সান্তিয়াগোর রাজপথে বন্দুকযুদ্ধ চলছিল। চিলির সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল রেনে শ্নাইডারকে অপহরণ করে গুলি করে একদল দুর্বৃত্ত। দুই দিন পর তিনি মারা যান। রেনেকে হত্যার কারণ হলো, তিনি সংবিধানের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন এবং আলেন্দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে অপারগতা জানান। এরপর নিক্সন প্রশাসন মনে করে, এই বামঘেঁষা সেনাপ্রধান থাকলে আলেন্দেকে সরানো সহজ হবে না। তাই তারা তাঁকে সরিয়ে দিয়ে একজন ডানপন্থী সেনাপ্রধানকে বসানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখে। আর সেনাবাহিনীকে যদি বিশ্বাস করানো যায় যে এ হত্যার পেছনে আলেন্দের হাত থাকতে পারে, তাহলে তারা নতুন প্রেসিডেন্টের ওপর ক্ষুব্ধ হবে।
এটা ছিল নিক্সনের বিদেশে যেকোনো মূল্যে বামপন্থী সালভাদর আলেন্দের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঠেকানোর সিআইএর ‘ছদ্মবেশী’ অভিযান। ১৯৫৩ সালে নিক্সন ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বলিভিয়া থেকে ব্রাজিল ও টেক্সাস সীমান্ত থেকে তিয়েরা দেল ফুয়েগো পর্যন্ত সমগ্র লাতিন আমেরিকায় বামপন্থীদের ঘায়েল করতে অভ্যুত্থান ঘটাতে ডানপন্থী স্বৈরশাসকদের মদদ দিতে থাকে। আইজেন হাওয়ারের প্রশাসনের অন্তিম মাসগুলোতে, কিউবান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর হত্যাচেষ্টাসহ যেসব তৎপরতা চলছিল, সেসবও ভালো জানা ছিল নিক্সনের।
চিলির রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্ট ও সামরিক নেতৃত্বের অনেকেই জানতেন, সিআইএ আলেন্দে ও তাঁর মিত্রদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। কিন্তু তা খুব একটা কাজে আসছিল না। চিলিতে কয়েক দশক ধরে গণতন্ত্র বহাল আছে। আলেন্দের নির্বাচনে এটাই প্রমাণিত হলো যে বামপন্থী নেতা আইনানুগভাবেই ক্ষমতা দখল করতে পারেন। ১৫ সেপ্টেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আলেন্দের বিজয় নিক্সনকে ক্রুদ্ধ করে। যদিও প্রথাগত ‘রাজনৈতিক যুদ্ধের’ নামে সিআইএ তাঁর বিরুদ্ধে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে আসছিল অনেক আগে থেকেই। নিক্সন ব্যক্তিগতভাবে সিআইএ-প্রধান রিচার্ডসন হেলমকে তাঁর (আলেন্দে) অভিষেক গ্রহণের পথ বন্ধ করার নির্দেশ দেন।
সিআইএর পরিচালক তাঁর জ্যেষ্ঠ আটজন কর্মকর্তাকে বলেছেন, নিক্সন আলেন্দেকে নিবৃত্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন, প্রয়োজনে সামরিক অভ্যুত্থানকে মদদ জোগাতে হবে। এবং এই পরিকল্পনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও চিলিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে গোপন রাখতে বলেছেন। সে সময়ে নিক্সন প্রশাসন অনেক সিদ্ধান্তই নিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে।
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি মার্কিন কংগ্রেস ও পররাষ্ট্র দপ্তরের বিরোধিতা সত্ত্বেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে সহায়তা করেছিল। নিক্সন বাংলাদেশে গণহত্যার কথা জানলেও আমলে নেননি। বরং মার্কিন কংগ্রেস ভারত ও পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো স্থগিত রাখার যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা উপেক্ষা করে তিনি তৃতীয় দেশ ইরান ও জর্ডানের মাধ্যমে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠান। তাঁকে এ কাজে বুদ্ধি–পরামর্শ দেন িকসিঞ্জার।
আইন অনুযায়ী ২৪ অক্টোবর চিলির কংগ্রেস (পার্লামেন্ট) আলেন্দের নির্বাচন অনুমোদন করে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনী ফল উল্টে দেওয়ার জন্য সিআইএর হাতে সাত সপ্তাহ সময় ছিল। সংস্থাটি দুই ধারায় কাজ চালাতে থাকে। এক. আলেন্দেকে পার্লামেন্টে ঠেকাতে তাঁর বিরুদ্ধে যথেষ্টসংখ্যক ভোট কেনা, দুই. সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো।
১৯৭৩ সালের অভ্যুত্থানের পাঁচ বছর পর সিনেটে জবানবন্দি দিতে গিয়ে সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা ডেভিড এটলি ফিলিপস বলেন, যিনিই চিলিতে বসবাস করবেন, জানবেন, যেমন আমি জেনেছি, চিলির একজন সিনেটরকে হয়তো কেনা সম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয়জন? কখনো না। তৃতীয়জন? কোনো সুযোগ নেই। দেশটিতে বহু বছরের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য আছে। দ্বিতীয় ধারা সম্পর্কে ফিলিপসের ভাষ্য হলো: চিলির সেনাবাহিনীও গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় আস্থাশীল। জেনারেল শ্নাইডার আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, সেনাবাহিনী সংবিধান মেনে চলবে এবং রাজনীতি থেকে দূরে থাকবে। এই ঘোষণাই তাঁর কাল হলো।
সিআইএর অবমুক্ত করা বার্তায় আরও জানা যায়: ১৯৭০ সালের ২৫ মার্চ, ২৭ জুন ও ৭ আগস্ট কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত কমিটির বৈঠক হয়, যেখানে ছদ্মবেশী অভ্যুত্থান এবং আলেন্দে ও তাঁর সোশ্যালিস্ট পার্টিকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭০ সালের শেষ দিনগুলোতে চিলিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কোরি নিয়মিত বার্তা পাঠাতেন, যা ছিল অকূটনৈতিকসুলভ। নির্বাচনের দিনে একের পর এক বার্তা পাঠিয়ে তিনি জানান, ‘আলেন্দের বিষয়ে পর্বতগুলো গর্জন করে উঠেছে। আমরা মারাত্মক পরাজয়ের সম্মুখীন।’
১২ সেপ্টেম্বর, কোরি ও সহকারী পররাষ্ট্রসচিব জন রিচার্ডসন গোপনে চিলির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রেইর সঙ্গে দেখা করে ওয়াশিংটনের অভিপ্রায় জানান। জবাবে ফ্রেই বলেন, আলেন্দেকে থামানোর সম্ভাবনা ২০ ভাগের এক ভাগ। তিনি কিছু করার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেন।
১৬ সেপ্টেম্বর সিআইএর পরিচালক রিচার্ডসন হেলম তাঁর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের জানান, প্রেসিডেন্ট নিক্সন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে চিলিতে আলেন্দের শাসন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। নিক্সন গোয়েন্দা সংস্থাকে এই মর্মে নির্দেশনা দেন যে হয় আলেন্দের ক্ষমতারোহণ ঠেকাও, অথবা তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করো। এ ব্যাপারে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে একটি কর্মপরিকল্পনাও পেশ করতে বলা হয়।
হেনরি কিসিঞ্জার ৭ অক্টোবর কমান্ডার কারামেসিনসকে সান্তিয়াগোয় অবস্থিত সিআইএর স্টেশন-প্রধানকে একটি তাৎক্ষণিক বার্তা পাঠাতে বলেন, যার সারমর্ম হলো:
‘সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করো এবং তাদের জানাও যে মার্কিন সরকার সামরিক সমাধান চায়। আমরা তাদের সমর্থন করব এখন এবং ভবিষ্যতেও....অন্তত অভ্যুত্থানের পরিবেশ তৈরি করো....সামরিক অভিযানে মদদ দাও।’
প্রেসিডেন্ট কেনেডি নিহত হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে চালিত হত্যা ষড়যন্ত্রের ধরন পাল্টে যায়। কিসিঞ্জার আলেন্দেকে তাক করা রাইফেলে আমেরিকান আঙুলের ছাপ রাখতে চাননি। কিন্তু নিক্সন-কিসিঞ্জার নির্দেশ দিয়েছেন যে সিআইএ চিলিতে এমন একজন জেনারেলকে বেছে নিক, যিনি সামরিক সমাধান করতে আগ্রহী হবেন। সে সময়ে সিআইএ সান্তিয়াগো সামরিক ঘাঁটির প্রধান জেনারেল কামিলো ভেলেনজুয়েলাকে উৎকোচ দিয়ে বশে এনেছিল এবং তিন ধাপে সামরিক অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র আঁটছিল।
এক. সেনারা জেনারেল শ্নাইডারকে অপহরণ এবং তাঁকে আর্জেন্টিনা নিয়ে যাবে, এর মাধ্যমে তারা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত সেনাপ্রধানকে অপসারণ করবে। দুই. এরপর সেনাবাহিনী আলেন্দের নির্বাচনকে অনুমোদন দেওয়ার আগেই চিলির পার্লামেন্ট ভেঙে দেবে। তিন. তারা সশস্ত্র বাহিনীর নামে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করবে।
সিআইএ ভেলেনজুয়েলাকে ৫০ হাজার ডলার, তিনটি সাব-মেশিনগান ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ার যন্ত্র দেয়—সবকিছুই ছিল কারামেসিনস অনুমোদিত এবং তার পেছনে ছিল হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন হাত। ১৩ অক্টোবরের মধ্যে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্য ব্যাপকভাবে জানাজানি হয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে সিআইএর সান্তিয়াগো স্টেশন-প্রধান হেনরি হেকসার ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান: ‘একটি ছদ্মবেশী অভ্যুত্থান ব্যাপক রক্তপাত ঘটাবে। সিআইএর মাধ্যমে হোয়াইট হাউসের উত্তর এ রকম: ‘একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আলেন্দেকে উৎখাত করা তাদের দৃঢ় ও অব্যাহত নীতি।’
আগামীকাল: পিনোশের বিচার হলে নিক্সন-কিসিঞ্জারের হবে না কেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com