মধ্যপ্রাচ্যের বহুপক্ষীয় কার্যক্রম প্রসারে ঐতিহাসিকভাবে দুটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো হয়েছিল। একটি হলো আরব লিগ, যেটি আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি–সংক্রান্ত একটি প্রভাবশালী পর্ষদ। আরেকটি হলো গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসি। এটি প্রধানত আরব দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে দেনদরবার করে থাকে।
নিজেদের মধ্যে যত বিভেদ থাকুক, মূলত আরবদের ঐক্য ধরে রাখা এবং ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরোধিতা করা ও নিজেদের মধ্যে হানাহানি রোধ করার লক্ষ্য নিয়ে এই দুই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল।
কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত আরব দেশগুলোকে অন্তত ফিলিস্তিনের অধিকার ইস্যুতে এক ছাতার তলায় রাখতে পেরেছিল। কিন্তু ২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুর বাইরে আরও তিনটি ইস্যুতে আরব দেশগুলোর অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা ছিল। এগুলো হলো ইরানের কার্যকলাপে উদ্ভূত হুমকিমূলক পরিস্থিতি, আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ও রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান। এসব বিষয়ের বিস্তার নিয়ে আরব দেশগুলোর মধ্যকার সুসম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য সম্বন্ধে পশ্চিমাদের বর্তমান নীতি হলো, এই বিষয়গুলোকে আরও উসকে দিয়ে আরব দেশগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দেওয়া।
সুন্নি আরব সরকারগুলো ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবকে তাদের স্বার্থের প্রতি হুমকি বলে মনে করে থাকে। একদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের চরম শত্রুতামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বাকি সবার বৈরিতা। এই দুই ধরনের দ্বন্দ্বের কারণে আরব দেশগুলোর ঐক্যে এক অশুভ গ্রহণ লেগেছে। আর এ কারণেই সমবেতভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
উপরন্তু, কয়েকটি আরব দেশের সরকার ইরানের হুমকি সামাল দেওয়ার নামে নজিরবিহীনভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। পর্দার আড়ালে বহুদিন ধরেই এই ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল। তবে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওয়ারশে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘ইরানবিরোধী’ সম্মেলনে বিষয়টি একেবারে খোলাখুলি হয়ে গেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ওই সম্মেলনকে আরব-ইসরায়েল সম্পর্কের নতুন সূচনা বলে অভিহিত করেছেন। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে শত্রুতা ও দ্বন্দ্ব যত বাড়বে, ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর এই ‘মৈত্রী’ আরও পোক্ত হবে।
সিরিয়া ও লিবিয়ায় চলতে থাকা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে জিহাদপন্থী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো বিধ্বংসী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মিসর, তিউনিসিয়া, জর্ডান ও আরও অনেক দেশে তারা হামলা চালিয়েছে। এই সন্ত্রাসীদের তৎপরতার জের ধরে আরব লিগের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষ বেড়ে চলেছে।
লিবিয়ায় গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ চাঙা হওয়ার পর আরব লিগ লিবিয়াকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে এবং সংগঠনটি গাদ্দাফিকে উৎখাতকারী ন্যাটো বাহিনীকে সমর্থন দেয়। গাদ্দাফির পতনের পর বিদ্রোহী বাহিনীকেও সমর্থন করে আরব লিগ।
এর পরপরই আরব লিগ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে সিরিয়াকেও বহিষ্কার করে। সিরিয়ার সদস্য পদ থাকা না-থাকা নিয়ে এখন আরব লিগের সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। কয়েকটি সুন্নি আরব সরকার সিরিয়ার সদস্য থাকার বিরোধিতা করে বলেছে, সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করেছে। তবে ইরাক ও তিউনিসিয়ার সরকার প্রকাশ্যেই সিরিয়াকে পুনরায় আরব লিগের সদস্য করার আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে আরব বসন্তের মধ্যেই গোটা মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানও দেশগুলোর অন্তঃকোন্দল বাড়িয়েছে। বিশেষ করে মিসর ও তিউনিসিয়ায় নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের জিতে যাওয়া আঞ্চলিক বিভক্তি বাড়িয়েছে।
মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করা প্রশ্নে তাদের মধ্যে বিভক্তি বাড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক সংগঠন জিসিসির ক্ষেত্রেও বিভক্তি স্পষ্ট। জিসিসিভুক্ত দেশ সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং জিসিসিবহির্ভূত আরও কয়েকটি দেশ ২০১৭ সালে কাতারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। তারা অভিযোগ করে, কাতার সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে এবং ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের জন্য দোহা অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে কাতারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও এ অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ঐতিহ্যগত বন্ধন যখন ছিন্ন হচ্ছে, ঠিক তখন ঘটনাক্রমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই অঞ্চল ইস্যুতে মার্কিন নীতি বদলে ফেলেছেন। তাঁর পূর্বসূরি ওবামা আরব ঐক্যের প্রতি খুব জোর দিয়েছিলেন, যার ফলে ২০১৫ সালে ইরান চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভব হয়েছিল।
ট্রাম্প ঠিক উল্টো পথে হেঁটে সেই চুক্তি বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছেন।
এখন আরব বিশ্বকে বুঝতে হবে নিজেদের মধ্যকার এই দূরত্বে তারা যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ঠিক ততটাই পশ্চিমা দেশগুলো ও ইসরায়েল লাভবান হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেসমিন এম. আল গামাল: আটলান্টিক কাউন্সিলের রফিক হারিরি সেন্টার ফর দ্য মিডল ইস্ট-এর একজন অনাবাসিক ফেলো