বিশ্বের সব থেকে বড় সাক্ষীগোপাল আরবের অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো। এরা সব দেখবে কিন্তু কোনো কথা বলবে না। কোনো নির্যাতন, দখলের বিরুদ্ধে আরবের বর্তমান শাসকদের পাওয়া যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানরা নির্যাতিত হলেও আরবের নেতারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন। টুঁ শব্দ পর্যন্ত করেন না। পাছে পশ্চিমা প্রভুরা খেপে যান। কিন্তু সময় পেলেই অন্য দেশের ফ্যাসিস্টদের হাতে চুমু খাবেন। আরবনিয়ন্ত্রিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক স্টেটস (ওআইসি) নিন্দা জানিয়েই ক্ষান্ত দেয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরবরা অত্যাচার-নির্যাতনকে সমর্থনও করছে। সম্প্রতি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান চীনের উইঘুর নীতি সমর্থন করেছেন। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জাতিগত গণহত্যায় সরাসরি সমর্থন না দিলেও চুপচাপ ছিলেন। কাশ্মীরের বিষয়েও রা নেই। এসব অনেক দূরের ঘটনা। নিজেদের ঘরের ভেতর দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল নীরব গণহত্যা পরিচালনা করলেও আরব দেশগুলো ইসরায়েলকে মেনে নিয়েছে। অবশ্য না মেনেই বা উপায় কী। ইসরায়েলের জন্ম, অটোমানদের পতন ও আরবের বিভিন্ন রাষ্ট্রের উদ্ভব যে একই সূত্রে গাঁথা।
সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, জর্ডান, লেবানন, মিসর দুর্গত ও মজলুম জনতার পক্ষের শক্তি না। বরং আরব বিশ্বের শাসকেরা নিজ দেশেই ভয়ংকর সব চরিত্র। গুম, হত্যা, জেলে পোরা, আরব শাসকদের নিত্যদিনের চর্চা। একটু এদিক-ওদিকে হলেই গর্দান যাবে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে। একটা সময় ছিল যখন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে আরবের অনেক জাতীয়তাবাদী নেতাই নেতৃত্বে ছিলেন। শোষণ ও শোষকের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। ঘড়ির কাঁটা উল্টে গেছে। আরব নেতারা বরং এখন শোষণ ও শোষকের পক্ষের বড় দূত।
সমসাময়িককালে আরব দেশগুলোর মধ্যে সব থেকে খারাপ ভূমিকা রাখছে যে দেশটি তার নাম সৌদি আরব। সুদানের সাম্প্রতিক স্বৈরশাসকবিরোধী লড়াইয়ে সৌদি আরব সরাসরিই সেনাবাহিনীকে সমর্থন ও অর্থ দিয়েছে। মিসরের তো নির্বাচিত সরকারকেই ফেলে দিয়েছে। সৌদিদের লোভের আগুনের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে ইয়েমেন। সিরিয়ার জঙ্গিদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে। জঙ্গিদের বড় একটি অংশই সৌদি সফর শেষে আইএসে যোগ দিয়েছে বলে ইদানীং বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়। আঞ্চলিক রাজনীতি বাদে দেশের ভেতরে এক কঠোর, অমানবিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে সৌদি আরব। বিদেশি শ্রমিক বিশেষ করে নারী গৃহকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
আরবের এই অচলায়তন ভেঙে দেওয়ার জন্য ২০১১ সালের আরব বসন্তে জেগে উঠেছিলেন তরুণেরা। সেই জাগরণকে ভালোভাবেই দমন করা হয়েছে। যদিও এখনো আলজেরিয়ার তরুণেরা আন্দোলনের ময়দানেই আছেন। লেবাননের রাজপথও তরুণদের দখলেই। কিন্তু গণতন্ত্র আসছে না আরবে। আরব বসন্ত, তাহরির স্কয়ার, ব্রাদারহুডের ক্ষমতায় আরোহণ, মুরসিবিরোধী আন্দোলনের পর মিসরে আবার সামরিক স্বৈরাচারই ক্ষমতা পোক্ত করেছে। মুরসির ঠিকানা এখন মিসরের এক সাধারণ সংরক্ষিত কবরস্থানে। মুরসির দাফনের সঙ্গে সঙ্গে আরবের গণতন্ত্রেরও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মিসর গোটা আরব বিশ্বের এক প্রতীক। মিসরকে দিয়েই আরবের রাজনীতি বোঝা যায়, বিশ্লেষণ করা যায়। হাজার হাজার গুম-খুনের রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে মিসর কোথাও পৌঁছাবে?
মিসর গাজার সঙ্গে তার রাফা সীমান্ত খুলে দিতে ভয় পায়। রাফা সীমান্ত বন্ধ রেখে গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধে সহায়তা করে। গাজা, পশ্চিমতীরে ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিশ্চুপ থাকে। পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়। হেজবুল্লাহরা ইসরায়েলের সৈন্যদের কোণঠাসা করলে যুদ্ধবিরতির জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে আবার সেই মিসরই। শুধু মিসরই না, গোটা আরবই এখন ইসরায়েলের পাশে। ফিলিস্তিনের পাশে কেউ নেই। নির্মম গণহত্যার শিকার হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। বিনিয়োগ, বৈশ্বিক রাজনীতি, তেলের বাজারসহ বিভিন্ন কারণে একইভাবে রোহিঙ্গা, উইঘুর বা কাশ্মীরিদের বিষয়ে তাদের অবস্থান কার্যত অকার্যকর।
সম্পদ, আয়তন, জনশক্তি; সবকিছু বিবেচনায় নিলে আরব হতে পারত বিশ্বের অন্যতম নিয়ন্ত্রক শক্তি। অটোমানদের পতনের আগ পর্যন্ত আরবেরা তৎকালীন বৈশ্বিক রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী নিয়ামক ছিল। ইসলামিক খেলাফতের আগেও আরবের প্রতিপত্তিকে ইউরোপ বরাবরই সমীহ করেছে। গ্রিক ও রোমান সভ্যতার সময়টুকু বাদ দিলে মিসরীয় সভ্যতা, মোসোপটেমীয় সভ্যতা, ইসলামিক সভ্যতার পীঠস্থান আরব বিশ্ব ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ছোট-বড় সভ্যতার পাদপীঠ সেই আরব এখন ইতিহাসের এক করুণ লগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। আরবের সর্বত্রই বিভাজন, যুদ্ধ, দমন-নিপীড়ন, নির্যাতনের থাবা। অথচ এক-এক সময় ইউরোপের সঙ্গে সমানতালে লড়েছে আরবরা।
ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে আরব সভ্যতার সঙ্গে ইউরোপীয় সভ্যতার টক্কর হয়েছে সব ক্ষেত্রেই। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় আরব ও ইউরোপ একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করেছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগকে পার করে ইউরোপ সাম্য ও মানবিকতার চর্চা প্রতিষ্ঠা করছে। অবশ্য ইউরোপের গণতন্ত্র বিতর্কের ঊর্ধ্বে না। কিন্তু আরবরা বরং উল্টো পথে চলছে। এরা রাজনৈতিকভাবে অগণতান্ত্রিক আর সামাজিকভাবে আইয়ামে জাহেলিয়াতের কাছাকাছি। যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমানোই আরব শাহিদের প্রধান কাজ। নিজের দেশে তো বটেই, অন্য দেশেও গণতান্ত্রিক উত্থানের টুঁটি চেপে ধরতে কসুর করে না।
ক্ষমতালোভী শাসকদের খপ্পরে পড়ে আরবের এক অমানবিক ও অসাম্যের পরিচয় গড়ে উঠেছে। আরব বিশেষ করে সৌদি আরব বলতেই এক বিভীষিকাময় ভয়ার্ত পরিবেশের চিত্র সামনে চলে আসে। একদিকে যুদ্ধ, ইয়েমেনের হাড়-জিরজিরে অনাহারক্লিষ্ট শিশুদের ছবি, আরেক দিকে মোহাম্মদ বিন সালমানদের লাগামছাড়া ভোগ-বিলাসের দৃশ্য।
আরবে মানবতার পতন ঘটেছে। জার্মান ফুটবলার মেসুত ওজিল উইঘুরদের ওপর চীনের চলমান নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন। সমালোচনা করেছেন নিউজিল্যান্ডের এক রাগবি খেলোয়াড়ও। আর মোহাম্মদ বিন সালমানেরা সমর্থন করছেন উইঘুর নির্যাতন। কার্যত মোহাম্মদ বিন সালমানেরাই এখন আরবের প্রতিনিধিত্ব করেন। সালমানদের আরবে মানবতার চর্চা হয় না। বরং আলোর মশালটা হঠাৎ হঠাৎই নিভে যায়। যা-ও টিম টিম করে জ্বলে ওই আরব বসন্তের তরুণদের হাতেই। ওরাই শেষ ভরসা। ওই তরুণদের মিছিলেই নতুন দিনের ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন, আল ফারাবিদের খোঁজ করা হয়। অগণতান্ত্রিক আরবে যেহেতু যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষাই শেষ কথা; তাই ইবনে সিনা, আল কিন্দিদের আর খোঁজ মেলে না। বরং বেরিয়ে আসে ওসামা বিন লাদেন, আবু বকর আল বোগদাদির মতো মানবতাবিরোধী মূর্তিমান সব আতঙ্ক।
ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন