২০২২ সালের ২৫ জুন। আমেরিকার ইতিহাসে দিনটি বিশেষভাবে উল্লেখ থাকবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নামও আগামী দিনগুলোতে বিশেষভাবে উচ্চারিত হবে।
বন্দুকের ‘অবাধ’ ব্যবহারে অন্তত কিছুটা রাশ টেনে ধরতে পারলেন বাইডেন। তাঁর সইয়ের মধ্য দিয়ে ওই দিন আইনে পরিণত হলো আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিলটি, তিন দশক ধরে যেটি করা সম্ভব হচ্ছিল না।
মার্কিন জনপরিসরসহ সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ স্যান্ডি হুক, বাফেলো, ইউভ্যালদে, গান কন্ট্রোল...। বন্দুক-সহিংসতা (গান ভায়োলেন্স) থেকে নিস্তার পাওয়ার আর্তি, আহ্বান। বিষয়টি নিয়ে রাজপথও উত্তাল হয়ে ওঠে। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের দাবিতে সরব মার্কিনিদের প্রতি সমর্থন জানান স্বয়ং প্রেসিডেন্ট। সুতরাং ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান—উভয় দলের আইনপ্রণেতাদেরও বড় অ্যাজেন্ডা হয়ে ওঠে ‘গান কন্ট্রোল’।
আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনপরিসর থেকে আইনসভার অন্দর—এই প্রথম আলোড়িত, তা অবশ্য নয়। এ দফায় বিষয়টি সামনে আসে ইউভ্যালদের রব এলিমেন্টারি স্কুলের মর্মন্তুদ ঘটনার পটভূমিতে। ২৪ মে সালভাদর রামোস নামের এক তরুণের বন্দুক হামলায় একলপ্তে ঝরে যায় স্কুলটির ১৯ শিশুর প্রাণ। বেঘোরে মারা পড়েন দুজন শিক্ষক।
২০০৭ সালে ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ৩২ শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে সারা বিশ্ব নিন্দায় মুখর হয়ে উঠেছিল। নিউটাউন হত্যাকাণ্ডের পরও সেই স্বর প্রতিধ্বনিত হয়। কলোরাডোয় সিনেমা হলে চালানো হামলার ঘটনায় সারা দুনিয়ায় ধিক্কার পড়ে গিয়েছিল। স্লোগান উঠেছিল—‘বন্দুক ঠেকাও, যুক্তরাষ্ট্র বাঁচাও’।
২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর নিউটাউনের স্যান্ডি হুক স্কুলে অ্যাডাম ল্যানজার নামের আরেক তরুণ বন্দুক হামলা চালিয়ে কেড়ে নিয়েছিলেন ২০ শিশুসহ ২৬ জনের প্রাণ। ২০১৮ সালে ফ্লোরিডার একটি স্কুলে চালানো হামলায় নিহত হন ১৭ জন শিক্ষার্থী-শিক্ষক।
এই সব কটি ঘটনায় নড়েচড়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ‘সাড়া না জাগানোর মতো’ বন্দুক হামলার ঘটনা দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনের। যেমন ইউভ্যালদের ঘটনার ১০ দিন আগে বাফেলোয় এক শ্বেতাঙ্গ তরুণের হাতে প্রাণ হারান ১০ কৃষ্ণাঙ্গ।
ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানায় মার্কিন মুলুকের ধারেকাছে কেউ নেই। বিশ্বের ৪৬ শতাংশ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে দেশটিতে; অথচ ৫ ভাগেরও কম জনসংখ্যার বাস সেখানে।
স্মল আর্মস অ্যানালাইটিকস অ্যান্ড ফোর কাস্টিংয়ের হিসাবে, ২০২০ সালে সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে মার্কিন অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো দেশটিতে ২২ দশমিক ৮ মিলিয়ন অস্ত্র বিক্রি করেছে। আগের বছরের তুলনায় এই বৃদ্ধি ৬৪ শতাংশ। ২০১৬ সালে সংখ্যাটি ছিল ১৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন।
এসব তথ্যে চোখ বুলালে কারও মনে হতেই পারে, এ কোন বন্দুকের মুলুক! এ কারণেই বুঝি দেশটির বন্দুক-সহিংসতাকে ‘আগ্নেয়াস্ত্রের অতিমারি’ অভিহিত করেন অনেকে।
২০০৭ সালে ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ৩২ শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে সারা বিশ্ব নিন্দায় মুখর হয়ে উঠেছিল। নিউটাউন হত্যাকাণ্ডের পরও সেই স্বর প্রতিধ্বনিত হয়। কলোরাডোয় সিনেমা হলে চালানো হামলার ঘটনায় সারা দুনিয়ায় ধিক্কার পড়ে গিয়েছিল। স্লোগান উঠেছিল—‘বন্দুক ঠেকাও, যুক্তরাষ্ট্র বাঁচাও’।
সব মৃত্যুই শোকের, বেদনার। ১৯ শিশুর গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়ার ঘটনা শোকে-বিচ্ছেদে সীমায়িত থাকে না। আবার তাই বলে এমন একটি বা কয়েকটি ঘটনাকে একটা দেশের পরিচিতির সূচক ধরে নেওয়াও অন্যায্য। জরুরত হলো, জাগতিক সহায়-সম্পদে ভরপুর মার্কিন সমাজের তলায় কোন ‘ফাঁক’ রয়ে গেছে, কিংবা কোন অসংগতি থেকে জন্মাচ্ছে এই ‘খুনের’ মানসিকতা, সব আলোচনা-পর্যালোচনার আলো পড়া উচিত এখানে।
বন্দুক-সহিংসতায় (হত্যা, হামলা ও আত্মহত্যা) ২০২০ সালে ৪৫ হাজার ২২২ মার্কিনির প্রাণ গেছে। এ সংখ্যা বছরওয়ারি হিসাবে তখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। ২০১৫ সালের তুলনায় যা ২৫ শতাংশ বেশি।
এ কথাও বাহ্য নয়, চকলেট-টফির মতো হাতের কাছে অস্ত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলে ইউভ্যালদের মতো হত্যাযজ্ঞের আশঙ্কা থেকেই যায়। স্মল আর্মস সার্ভে বলছে, প্রতি ১০০ জন মার্কিনির হাতে ১২০ দশমিক ৫টি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৮।
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অধিকার যুগপৎ সাংবিধানিক ও ‘ঐতিহাসিক’। চোখের আড়ালে পড়ে থাকা বিশাল এ মহাদেশের হদিস পাওয়ার পর ইউরোপীয়রা সেখানে ঘাঁটি গাড়তে থাকে। আদিবাসীদের নির্মূলে তাদের প্রধান ভরসা ছিল বন্দুক। এতকাল পর, যখন দেশের কপালে গণতন্ত্রের সুস্পষ্ট তিলক আঁকা, তখনো তারা আত্মরক্ষায় ‘বন্দুক’ ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না!
ইতিহাস সাক্ষী, আমেরিকায় অভিবাসী ইউরোপীয়দের বিস্তারের দ্বিতীয় পর্বে মাথা তোলে বর্ণবিদ্বেষ; সেই আবহেও শ্বেতাঙ্গদের আক্রমণ-আত্মরক্ষার ভরসা ছিল বন্দুকে। ১৭৯১ সালে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতে বলা হয়, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে নাগরিকেরা অস্ত্র রাখতে পারবেন।
আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কথা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানও তাই সবিশেষ আলোচনায় উঠে আসে। ঐতিহাসিক এই অধিকার, যুক্তি কিংবা ‘অজুহাত’ ধরে যে প্রতিবন্ধকতা মূর্ত হয়ে ওঠে, তা অবশ্য রাজনৈতিক। এই রাজনীতির অন্তরালে অস্ত্রকারবারিদের লম্বা হিসাব, লবিস্টদের ফুলেফেঁপে ওঠার দীর্ঘ ফিরিস্তি। ২০০৮ সালে একবার এবং ২০১০ সালেও অস্ত্র আইন পরিবর্তনসংক্রান্ত কাজিয়া সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। দুবারই সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী বিজয়ী হয়।
এলোপাতাড়ি গুলি চালানোর ঘটনাগুলো মিডিয়ার মনোযোগ পেলেও আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে আত্মহত্যা নিয়ে তেমন কথাবার্তা হয় না। অথচ ‘আড়ালে থাকা’ এসব ঘটনার হার ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ, বন্দুক–সংক্রান্ত সব মৃত্যুর অর্ধেকের বেশি আত্মহত্যার ঘটনা।
আগ্নেয়াস্ত্রের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী লবি ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ)। সংগঠনটি নিজেদের পথ পরিষ্কার রাখতে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার খরচ করে।
গত ১২ এপ্রিল জর্জিয়া ২৫তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, সেখানে লাইসেন্স ছাড়াই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা যাবে। বলাই বাহুল্য, এর প্রবল সমর্থক এনআরএ। সংগঠনটি জর্জিয়ার এই পদক্ষেপকে অভিহিত করে ‘দ্বিতীয় সংশোধনীর জন্য স্মরণীয় মুহূর্ত’ বলে।
নিউটাউনের হত্যাযজ্ঞের পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওবামা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ‘সর্বশক্তি’ প্রয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তখনো বিলিয়ন ডলারের প্রশ্নটি উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত লবিস্ট-করপোরেট-পলিটিশিয়ান বলয় ভাঙতে পারবেন তো তিনি? পারেননি। ১৯৯৪ সালে আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর আংশিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন সেসময়ের প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন। ২০০৪ সালে নবায়ন না হওয়ায় কার্যকারিতা হারায় তা।
হ্যাঁ, এবার ৫২ শতাংশ মার্কিনি কঠোর অস্ত্র আইন চাইছেন। এই জনমতের প্রতিফলন ঘটল মার্কিন কংগ্রেসে। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিলের পক্ষে রায় দিলেন আইনপ্রণেতা।
বিলটি পাসের আগে অ্যাসল্ট উইপন নিষিদ্ধের ব্যাপারে নিজের জোরালো অবস্থান তুলে ধরেছিলেন বাইডেন। সেটা করতে না পারলে নিদেনপক্ষে আগ্নেয়াস্ত্র কেনার বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করা উচিত বলে মত দিয়েছিলেন।
বয়সের গুরুত্বটা বোঝা যায় এযাবৎ সংঘটিত বড় হামলাগুলোর দিকে তাকালে। নিউটাউন, ইউভ্যালদে, বাফেলোয় হামলা চালানো প্রত্যেকের বয়স ১৮। নিউটাউনে ও ইউভ্যালদে হামলায় ‘এআর-১৫’ বন্দুক ব্যবহার করা হয়েছিল।
অ্যাসল্ট উইপন নিষিদ্ধ হলো না—এটুকু খামতির সঙ্গে একটা ‘খচখচানি’ও রয়ে গেল। ২৩ জুন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিলটি মার্কিন সিনেটে পাস হয়। সেদিনই সুপ্রিম কোর্ট বললেন, জনসমক্ষে অস্ত্র বহন করার অধিকার মার্কিন জনগণের রয়েছে। রায়টি এসেছে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের জনসমক্ষে অস্ত্র বহনসংক্রান্ত শতাব্দীপ্রাচীন একটি বিধিকে (জনপরিসরে সঙ্গে অস্ত্র রাখতে অনুমতি প্রয়োজন) চ্যালেঞ্জ করে দায়ের মামলায়।
সুপ্রিম কোর্টে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতি রক্ষণশীল। ফলে বিপক্ষে রায় আসতে পারে, এমন আশঙ্কা আগে থেকেই করা হচ্ছিল। বাস্তবে হয়েছেও তাই। বলাই বাহুল্য, এই মামলার অন্যতম পক্ষ ‘বন্দুকের বন্ধু’ এনআরএ। তাই সংবিধানের দোহাই পেড়ে বাইডেনের বিপক্ষে এনআরএ আদালতের গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
hello.hasanimam@gmail.com