আমি প্রেসিডেন্ট ওবামা বলছি...

.

প্রিয় দেশবাসী, আপনাদের সামনে আমি আজ দাঁড়িয়েছি ভগ্নহৃদয়ে, তবে একই সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চিত্তে।
আপনারা সবাই জেনেছেন, দেখেছেন, শুনেছেন কীভাবে সান বার্নাডিনোতে দুজন আততায়ী নির্বিচারে গুলি করে ১৪ জন নিরীহ নাগরিককে হত্যা করেছে, আহত করেছে আরও ৩০ জনকে। এসব হতাহতের ঘটনায় আমি আপনাদের মতোই ব্যথিত, ভগ্নহৃদয়। নিহত-আহত ব্যক্তিদের স্বজনদের প্রতি রইল আমার আর আমাদের সমবেদনা ও প্রার্থনা।
এই পাশবিকতা, এই নির্মমতা, এই বর্বরতাকে রুখতে হবে। আপনাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশবাসীর কাছে এটাই আমার প্রতিজ্ঞা। এসব আক্রমণের মুখে প্রিয় দেশবাসীর জান ও মালের নিরাপত্তার জন্য আমার সরকার কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা আপনাদের অবগত করার আগে অন্য কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে চাই, যাতে আপনারা আমাদের প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলোর যথার্থতা সহজেই অনুধাবন করতে পারেন।
প্রিয় দেশবাসী, আপনারা জানেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা ১৭৭৬ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। এখনকার ব্রিটিশ সরকার অনেক ইস্যুতে আমাদের পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে এই ব্রিটিশদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয়েছিল। আমাদের স্বাধীনতা যোদ্ধার বীর রক্তে বোস্টন, নিউইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, ওয়াশিংটনসহ বহু শহরের মাটি লালে লাল হয়েছিল।
আমাদের ভুললে চলবে না যে আমাদের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে চার-চারটি বছর যুদ্ধ করতে হয়েছিল কনফেডারেশনের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে তিনি জিতেছিলেন। কিন্তু তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল আততায়ীর গুলিতে। আমার মতো যে অশ্বেতাঙ্গদের তিনি দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, সেই অশ্বেতাঙ্গদের উত্তরসূরি হিসেবে আমি এবং আমরা মহান আব্রাহাম লিংকনের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু অশ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গদের ষড়যন্ত্র, অত্যাচার, নিপীড়ন আজও বন্ধ হয়নি। আমেরিকার বহু শহরে এখনো শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অশ্বেতাঙ্গ নিরপরাধ যুবকদের গুলি করে মারে। আব্রাহাম লিংকনের অবদান আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে, যাতে স্বার্থান্বেষী মহল তরুণ প্রজন্মকে ভুল না বোঝায়, খারাপ পথে প্ররোচিত না করতে পারে।
প্রিয় দেশবাসী! আপনারা জানেন, গণতন্ত্র ও ধনতন্ত্র রক্ষার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর থেকে আমেরিকান সৈন্য ও সেনাপতিরা বিশ্বের বহু দেশে সংগ্রামে-যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। ফিদেল কাস্ত্রোকে না পারলেও ইরানের মোসাদ্দেক, কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, চিলির আইয়েন্দে, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণসহ বহু শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রনায়ককে অকালে ইহধাম ত্যাগ করতে আমাদের সিআইএ সাহায্য করেছে। গত শতাব্দীর ভিয়েতনাম ইত্যাদির কথা বলে আমার বক্তৃতা দীর্ঘায়িত করব না, তবে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে আফগানিস্তান, ইরাক আর এখন সিরিয়ায় আমাদের সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছে।
কিন্তু আমাদের শত্রু অনেক। আমরা শুধু এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বলতে গেলে সারা দুনিয়ায় ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, ধনতন্ত্র আর উন্নয়নের জন্য কাজ করি, সাহায্য-সহযোগিতা করি, প্রয়োজনে যুদ্ধও করি। কিন্তু সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমাদের শত্রুরা আমাদের সাফল্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। প্রিয় দেশবাসী! আমাদের চতুর্দিকে ইতিহাস বিকৃতি ঘটছে। আমাদের, বিশেষত আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে। আমরা সঠিক ইতিহাসের দিকে নজর দিইনি বলেই আজ সান বার্নাডিনোর মতো ঘটনা এ দেশে ঘটছে।
আমাকে দুঃখের সঙ্গে এ পর্যায়ে দুটি কথা বলতে হবে। প্রথমত, এই ২০১৫ সালে এ পর্যন্ত আমেরিকায় নির্বিচার গুলিবর্ষণে ৪৫০ জনের বেশি লোক নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন। দ্বিতীয়ত, রিপাবলিকান পলিটিশিয়ানরা সান বার্নাডিনোর ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ‘পলিটিকস’ শুরু করে দিয়েছেন। রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর অন্তত তিনজন এই ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে উল্লেখ করেছেন আর আমার সমালোচনা করেছেন এটাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে স্বীকার বা স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করতে চাই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কখনো সন্ত্রাসী বা জঙ্গিগোষ্ঠী ছিল না, বর্তমানেও নেই এবং আমি যত দিন আপনাদের প্রেসিডেন্ট আছি, তত দিন এ দেশে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের কোনো ঠিকানা হবে না।
রিপাবলিকানরা আসন্ন নির্বাচনে তাদের ভরাডুবির কথা জেনেই আজ জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ নিয়ে মহা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। আমাদের সরকারের তথা ডেমোক্রেটিক পার্টির সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়েই তারা এই খেলায় নেমেছে। বিশ্বদরবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তারা ক্ষুণ্ন করতে চাইছে। সারা বিশ্ব জানে, আমরা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিচ্ছি, এমন প্রেক্ষাপটে খোদ আমাদের দেশেই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদী আক্রমণের কথা বলে রিপাবলিকানরা আমাদের, তথা সব আমেরিকানের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। আমার ধারণা, এই ষড়যন্ত্রে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কিছু অন্ধভক্ত ইন্ধন জোগাচ্ছে। রাজতন্ত্রের এই ভক্তদের আমরা দেখেছি প্রিন্স উইলিয়াম আর কেট এবং নবজাতক শিশুদের নিয়ে মাতামাতি করতে। লিফলেট বিলি করতে। সম্ভবত তাদের ইন্ধন জোগাচ্ছে আমাদের উত্তরের প্রতিবেশী কানাডিয়ানরা। কারণ, রানি এলিজাবেথ তো কানাডারও রানি।
এ দেশে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব প্রমাণিত হলে কী থেকে কী হয় তা বোঝা মুশকিল। তবে এটা নিশ্চিত, আমাদের ভাবমূর্তি যাবে, নেতৃত্বও যাবে। সান বার্নাডিনোসহ সব বন্দুকধারী দেশকে অশান্ত করতে চাইছে। দেশবাসী, আপনারা সবাই জানেন যে আমাদের দেশের আয়তন বিশাল। আর আমরা ৩০ কোটি। তা সত্ত্বেও এসব হত্যাকাণ্ড এই বিশাল দেশটাকে অস্থিতিশীল করার এক ষড়যন্ত্র। কিন্তু এ দেশকে আমরা অস্থিতিশীল করতে দিতে পারি না। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হোক, এটাও কেউ বরদাস্ত করবে না। কিন্তু নিরীহ, নিরপরাধ নাগরিকদের হতাহত হওয়া রোধ করা আমার ও আমার সরকারের পবিত্র দায়িত্ব।
চরমপন্থী, বন্দুকধারীরা আজকাল অনেক বেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তাদের অস্ত্র ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি আধুনিক ও মারাত্মক। তারা লেটেস্ট টেকনোলজিতে পারদর্শী। তাদের সমর্থক ও সহায়ক গোষ্ঠী শুধু রিপাবলিকান পার্টিতেই সীমাবদ্ধ না। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী দল, উগ্র ইহুদিবাদের অন্ধ সমর্থক, লিংকন-কেনেডির হত্যাকারীদের উত্তরসূরিসহ বহু দল, গোষ্ঠী ও গ্রুপ এ দেশে ভীষণভাবে সক্রিয়।
দেশের এই সন্ধিক্ষণে তাই আমি আপনাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিম্নে বর্ণিত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি:
আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে কাউকে বন্দুক হাতে দেখলে বা শরীরে অথবা পকেটে বন্দুক লুকায়িত আছে সন্দেহ করলে তাৎক্ষণিকভাবে সে ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করতে পারবে। নিহত ব্যক্তি ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে’ বলে আখ্যায়িত হবে।
রিপাবলিকান পার্টির নেতা-কর্মীরা যেহেতু স্পষ্টতই দেশের অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করছে, ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে, দেশকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে, সেহেতু এটা স্পষ্ট যে এই ২০১৫ সালে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের যত ঘটনা ঘটছে, তাতে তারা উসকানি দিয়েছে। নির্বিচারে গুলিতে হতাহতের মামলাগুলোতে রিপাবলিকান পার্টির নেতা-কর্মীদের অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিয়েছি। বলা বাহুল্য, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন আমাদের নির্দেশ অনুযায়ী মামলা দায়ের করবে। বিচার বিভাগও যাতে আমাদের নির্দেশ অনুযায়ী রায় প্রদান করে আমরা তার জন্য প্রয়োজনীয় আইন পাস করব।
প্রিয় দেশবাসী! নাইন-ইলেভেনের পর এক যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। সে সময়ে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিইনি। তারই ফলে বছরের পর বছর শত-সহস্র আমেরিকান বেঘোরে প্রাণ দিয়েছে, সান বার্নাডিনোসহ বিভিন্ন জায়গায়।
আমার ভাষণের শুরুতেই বলেছিলাম, আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করব। প্রিয় দেশবাসী! আমেরিকানদের প্রাণ বাঁচাতে:
প্রথমত, আমি ইন্টারনেট অবৈধ ঘোষণা করছি, নিষিদ্ধ করছি। ডাক বিভাগ আগামী এক মাস বন্ধ থাকবে। আন্তনগর বিমান চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে বাস আর ট্রেন চালু থাকবে।
সঠিক ঘটনা, ইতিহাস ও তথ্য প্রচার নিশ্চিত করার জন্য সরকারি টিভি চালু হবে। বেসরকারি টিভি আজ থেকে সংবাদ প্রচার করবে না। টক শো অবিলম্বে নিষিদ্ধ এবং রিপাবলিকান পার্টির কোনো প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে না।
ড. শাহদীন মালিক: অাইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। নির্বাচন কমিশনের সাবেক আইনজীবী।